ক্ষমতায় আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গবাসীর মধ্যে ‘বঞ্চনা ও অবহেলা’ নিয়ে যে অভিমান রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করবেন। সেই অভিমানের প্রধান উত্স প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মহাকরণ বা হালে
নবান্নের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। সেই অবস্থার পরিবর্তন করতেই এ বার উত্তরবঙ্গের নিজস্ব সচিবালয় ‘উত্তরকন্যা’ গড়ল রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী আজ, সোমবার উত্তরকন্যার উদ্বোধন করবেন। এই সচিবালয়ের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগও দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
উত্তরবঙ্গের প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, এই সচিবালয় হলে নানা প্রকল্প-প্রস্তাব নবান্ন বা কলকাতার অন্য সরকারি দফতরে পাঠিয়ে তা অনুমোদনের জন্য দিনের পর দিন হাপিত্যেশ করে আর বসে থাকতে হবে না। কথায়-কথায় অফিসারদের কলকাতায় ছোটাছুটি করাও বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাতে সময় এবং অর্থ দুই-ই বাঁচানো যাবে। ফলে উন্নয়নেও গতি আসবে। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা জানান, উত্তরকন্যায়
কাজ শুরু হওয়ার পরে উত্তরবঙ্গের সমস্যা উত্তরবঙ্গেই মেটানোর সুযোগ বাড়বে আর তাই উত্তরবঙ্গ আত্মনিয়ন্ত্রণেরও সুযোগ পাবে।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “পাহাড় ও সমতলের মানুষকে আগে অনেক বঞ্চনা, অবহেলা করা হয়েছে। আমি কখনও তা মানতে পারিনি। তাই পাহাড় ও সমতলের উন্নয়নে গতি আনার জন্য, শান্তি বজায় রাখার জন্য যা যা করার করব বলেছিলাম। উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা সচিবালয় করা হবে বলে কথা দিয়েছিলাম। সেটাই করেছি। উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে আমি দায়বদ্ধ।”
ঘটনা হল, ‘উত্তরকন্যা’ নামে ‘মিনি মহাকরণ’ হলেও আয়তন বিশাল। প্রায় ৩০ বিঘা জায়গা জুড়ে তৈরি হচ্ছে ওই সচিবালয়। আপাতত সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস, ভিডিও কনফারেন্সে করার জায়গা তৈরি হয়েছে। সেখানে ২০টি দফতরের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের অফিসারদের বসার জন্য আলাদা ঘর হচ্ছে। এখনও নির্মাণের অনেকটাই বাকি। কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই এই সচিবালয় তড়িঘড়ি চালু করার পিছনে অবশ্য শাসক দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই দেখছে সিপিএম সহ একাধিক
বিরোধী দল। লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণার আর খুব বেশি দেরি নেই। তাঁদের দাবি, সে জন্যই ‘উত্তরকন্যা’ অসমাপ্ত অবস্থাতেই উদ্বোধন করে দেওয়া হচ্ছে।
তৃণমূলের তরফে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য এই বিরোধীদের এই কটাক্ষ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি নন। গৌতমবাবু বলেন, “উত্তরের পাহাড়-সমতলের জন্য মুখ্যমন্ত্রী যা করছেন, তাতে আমজনতা অভিভূত। বালুরঘাট-থেকে কোচবিহার, মালদহ থেকে রায়গঞ্জ, দার্জিলিং থেকে জলপাইগুড়ি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে উন্নয়নের তদারকি করছেন। শুধু দার্জিলিঙেই তো আড়াই বছরে ২৫ বার এসেছেন। এখন উত্তরকন্যা হওয়ার পরে তো উত্তরবঙ্গের বাসিন্দারা মুখ্যমন্ত্রীকে আরও বেশি করে পাবেন। এটা সকলেই বুঝছেন।” প্রসঙ্গত, চলতি সফরের পরে ফেব্রুয়ারিতেই মুখ্যমন্ত্রী ফের ডুয়ার্সে আদিবাসীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেই সময়েও তাঁর উত্তরকন্যায় যাওয়ার কথা রয়েছে।
উত্তরকন্যার জন্য এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আরও অন্তত ৩০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের কী কী লাভ হবে?
উত্তরকন্যায় ২০টি দফতরের যুগ্ম সচিবরা নিয়মিত বসবেন। সেখানে ভিডিও কনফারেন্সের অত্যাধুনিক ব্যবস্থাও রয়েছে। তাই কলকাতা তো দূরের কথা, উত্তরবঙ্গের জেলাশাসক-পুলিশ সুপার সহ শীর্ষ অফিসারদের কথায়-কথায় আর শিলিগুড়িতেও আসতে হবে না। বছরের একাধিকবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীই উত্তরকন্যায় বসবেন। তাই অনেক প্রকল্পের জট আগের তুলনায় কম সময়ে কেটে যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উত্তরকন্যায় সব দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করবেন।
সরকারি সূত্রের খবর, আজ, দুপুরের বিমানে মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়ি পৌঁছবেন। রাতেই তিনি মিরিক
চলে যাবেন। সেখানে ২১ জানুয়ারি তামাঙ্গ সম্প্রদায়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেই রাতেই
দার্জিলিঙে যাবেন। পর দিন ‘রায় ভিলায়’ ভগিনী নিবেদিতার বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। ২৩ জানুয়ারি গিদ্দে পাহাড়ে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শিলিগুড়িতে যাবেন। ২৪ জানুয়ারি কলকাতা ফিরে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর।
বাম নেতারা অবশ্য ‘উত্তরকন্যা’য় কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহেই রয়েছেন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, “সরকারি কোষাগারের নানা ঘাটতির কথা বলেও বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে তাড়াতাড়ি উত্তরকন্যা চালু করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এই ভাবে কী ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ হয়? আমরা মনে করি, পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করে বিকেন্দ্রীকরণ হতে পারে।” সেই সঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, “যাই হোক, উত্তরকন্যা কতটা কাজের হবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।” অশোকবাবুর সংযোজন, “একটা লাভ অবশ্য উত্তরকন্যা থেকে হতে পারে। সেটা হল, উত্তরবঙ্গের নানা এলাকায় যুগ্ম অধিকর্তা পর্যায়ের কিছু দফতর আমাদের সময়ে খোলা হয়েছে। সেই সব দফতরের অনেকগুলিই ভাড়া বাড়িতে রয়েছে। সেগুলি উত্তরকন্যায় গেলে সরকারের খরচ কমবে।” |