পুরুলিয়া নয়, নয় রঘুনাথপুরও। এ বার পুরুলিয়া জেলা বইমেলা বসছে বলরামপুরে। জেলা বইমেলা কমিটির এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিভিন্ন মহলে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুর শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলনায় ভাল হলেও বলরামপুর যাওয়ার পরিবহণ ব্যবস্থা ততটা ভাল নয় বলে মত জেলার বইপ্রেমীদের। তাঁদের মতে, বরাবর জেলা সদর পুরুলিয়ায় বইমেলা হয়ে এসেছে। গত বার রঘুনাথপুরে বইমেলা আসর বসেছিল। সেখানেও অনেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু বলরামপুর জেলার প্রায় একপ্রান্তে হওয়ায় সেখানে বইপ্রেমীরা গিয়ে কতক্ষণ নতুন বইপত্র নাড়াচাড়া করতে পারবেন, কেনাকাটা করার ফুরসৎ কেমন পাবেন তা নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁদের প্রশ্ন, জেলার একপ্রান্তে বইমেলার এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে?
জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ১২০টির বেশি গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ এই বইমেলা থেকে প্রচুর বই কেনেন। তাঁরাও সমস্যায় পড়বেন বলে জানিয়েছেন। তবে মেলার উদ্যোক্তাদের দাবি, পুরুলিয়া সদরের মতোই ট্রেন ও বাস যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে বলরামপুরে। ফলে বইমেলা ঘিরে বিতর্ক হওয়া আদৌও বাঞ্ছনীয় নয়। বইমেলা কমিটির অন্যতম সদস্য তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর বক্তব্য, “আমরা চাইছি জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বইমেলা হোক। সে জন্যই গতবার রঘুনাথপুরে বইমেলা করা হয়েছিল। এ বার বইমেলার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে বলরামপুর।”
২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে সাত দিনের বইমেলা। তৃণমূলের অন্দর ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মতে, বলরামপুর থেকে নির্বাচিত সভাধিপতি সৃষ্টিধরবাবুর ইচ্ছাতেই এ বার বইমেলার জন্য বলরামপুরকে নির্বাচন করা হয়েছে। |
বইমেলা কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই কমিটির অনেক সদস্য এ বার পুরুলিয়া শহরেই বইমেলা করাতে চেয়েছিলেন। মেলার স্থান নির্বাচন করা নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে তাঁরা পুরুলিয়া শহরের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু সভাধিপতি বলরামপুরেই বইমেলা করার দাবি ধরে থাকেন। পুরুলিয়া শহরের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়, এখানে মূলত যোগযোগ ব্যবস্থা ভাল রয়েছে। তা ছাড়া স্থানের উপর বই বিপণনের বিষয়টিও জড়িয়ে রয়েছে। যে কারণে গতবার মহকুমা সদর রঘুনাথপুরে বইমেলা করা হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার ঘাটতি থাকায় অনেক বইপ্রেমীকেই মেলায় যেতে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কমিটির কিছু সদস্যের কথায়, “মনে রাখতে হবে অন্য মেলার সঙ্গে বইমেলার মূলগত প্রভেদ রয়েছে। ফলে প্রত্যন্ত এলাকায় অন্য মেলা করা আর বইমেলা করা এক বিষয় নয়।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোদ সভাধিপতির ইচ্ছাকে মান্যতা দিতেই বলরমাপুরে মেলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে তৃণমূলের অভ্যন্তরেও। বলরামপুরে বইমেলা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা তৃণমূলের কিছু নেতাও। ওই বৈঠকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত ছিলেন বইমেলা কমিটির দুই সদস্য রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্নচন্দ্র বাউরি ও মানবাজারের তৃণমূল বিধায়ক সন্ধ্যারানি টুডু। জেলা বইমেলার কয়েকদিন আগেই নিতুড়িয়ায় নিজের উদ্যোগে একটি বইমেলা করতে চলেছেন পূর্ণচন্দ্রবাবু। তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক কে পি সিংহদেও-র কথাতেও বইমেলার স্থান নির্বাচন করা নিয়ে অসন্তোষের ইঙ্গিত মিলেছে। তিনি বলেন “বইমেলার স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নজরে রাখা দরকার কোন এলাকায় বইমেলা হলে পাঠক বা ক্রেতারা সহজেই সেখানে পৌঁছতে পারবেন। এ ছাড়াও মেলায় আসা প্রকাশক সংস্থাগুলির বিপণন ও বাজারের দিকগুলি দেখেই স্থান নির্বাচন করা জরুরি।”
বাসিন্দাদের বক্তব্য, ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বলরামপুরে বইমেলা হলে সেখানে যেতে সমস্যায় পড়বেন রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকা-সহ ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুণ্ডির মতো এলাকার বইপ্রেমীরা। বইমেলায় প্রতিদিন নিয়ম করে হাজিরা দেন পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক মনোজিত মণ্ডল ও আদ্রার বাসিন্দা ছড়াকার অমল ত্রিবেদী। বলরামপুরে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে কতজন পাঠক বা বইপ্রেমী যেতে পারবেন তা নিয়ে তাঁরাও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মনোজিতবাবুর কথায় “অনেকক্ষণ ধরে প্রতিটি স্টলে গিয়ে বই নাড়াচাড়া না করতে পারলে বা ঘোরাঘুরি না করা গেলে বইমেলার আমেজটাই পাওয়া যায় না। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা থাকলে তা কখনোই সম্ভব নয়। বলরামপুরে বইমেলায় কতটা সময় বের করে যেতে পারব তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।” আর অমলবাবু বলেন, “অন্য বার বইমেলায় প্রতিদিনই যেতাম। এ বার হয়তো দু’-একদিন যেতে পারব।” দু’জনেরই বক্তব্য, জেলা বইমেলা সেখানেই হওয়া বাঞ্ছনীয় যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। বইয়ের প্রসারের জন্য স্থানীয় ভাবে উদ্যোগ নিয়ে আঞ্চলিক স্তরে বইমেলা করা যেতে পারে।
এ বার বইমেলায় যাওয়া নিয়ে নিমরাজি জেলারই কিছু প্রকাশক সংস্থা। গত ১২-১৪ বছর ধরে জেলা বইমেলায় নিজের প্রকাশিত বইপত্র নিয়ে গিয়েছেন চেলিয়ামার বাসিন্দা লোকগবেষক সুভাষ রায়। তাঁর মন্তব্য, “বলরামপুরে বইমেলা হলে সেখানে যাব কি না ভাবতে হবে।” তাঁর যুক্তি, ওই রকম প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে থাকার সমস্যা রয়েছে। আবার জেলা সদরের মেলায় যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতা আসেন, তাঁরা ওই এলাকায় যাবেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর সঙ্গেই সহমত পুরুলিয়ার বাসিন্দা লোক-সংস্কৃতির গবেষক তথা অন্য একটি প্রকাশনা সংস্থার মালিক দিলীপ গোস্বামীও। তিনি বলেন, “বলরামপুরে বইমেলার স্থান নির্বাচন ছোট পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে প্রকাশক, লেখক বা বইপ্রেমীদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরা সারা বছর ধরে জেলা বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি। তাই যেখানেই হোক, বই বিক্রি করতে যেতে বাধ্য। কিন্তু সেখানে পাঠক বা ক্রেতা কতটা পাব সংশয়ে রয়েছি।” তবে সৃষ্টিধরবাবুর বক্তব্য, “বলরামপুর থেকে ট্রেন, বাস সবই রয়েছে। কলকাতা থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের সমস্ত জেলার সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ধর্মশালা, হোটেলে প্রকাশকদের থাকার সমস্যা হবে না।” তাঁর দাবি, ব্লক সদরের মতো এলাকায় বইমেলা করলে বইয়ের প্রচার ও প্রসার ঘটবে। বই সম্পর্কে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের আগ্রহ বাড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বইমেলা কমিটি। পুরুলিয়ার জেলাশাসক তথা বইমেলা কমিটির চেয়ারম্যান তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “বিভিন্ন জেলায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা জায়গায় বইমেলা করা হচ্ছে। বইয়ের প্রসার ও প্রচারের দিক দিয়ে এটা ইতিবাচক।” তিনি জানান, “প্রয়োজন হলে বইমেলার দিনগুলিতে বলরামপুর পর্যন্ত অতিরিক্ত বাস চালানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।” |