শেষ বার তাঁকে দেখা গিয়েছিল শরৎ বসু রোডের একটি প্রাইভেট টিউশনের কোচিংয়ে। শৌচাগারে যাওয়ার নাম করে সেখান থেকে বেরোনোর পর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই বছর আঠারোর সুরজিৎ মণ্ডলের। এ বছর তাঁর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ছাত্রের বাড়ি বেলতলা রোডের পেয়ারাবাগানে। শনিবার রাতে বালিগঞ্জ থানা লাগোয়া নাককাটা গলি থেকে উদ্ধার হয়েছে সুরজিতের রক্তমাখা জামা এবং চপ্পল।
পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে অপহরণের মামলা শুরু করলেও ২৪ ঘণ্টা পরেও খোঁজ নেই সুরজিতের। অভিযোগ পেয়ে ওই ছাত্রের দুই বন্ধুকে বালিগঞ্জ থানায় দফায় দফায় জিজ্ঞসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু কোনও হদিস মেলেনি। রবিবার রাতে সুরজিতের পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে গিয়ে বিক্ষোভও দেখান।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার বিকেলে শরৎ বসু রোডে পদ্মপুকুরের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে যায় পেয়ারাবাগানের ওই ছাত্র। পুলিশ জানতে পেরেছে, সেখানে থাকাকালীন সুরজিতের মোবাইলে একটি ফোন আসে। পরিবারের দাবি, এর পরেই শৌচাগারে যাওয়ার নাম করে সুরজিৎ বেরিয়ে যায় বলে প্রাইভেট টিউশনের ওই শিক্ষক তাঁদের জানিয়েছেন। সুরজিতের বাবা নিরঞ্জন মণ্ডলের অভিযোগ, ওখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে পৌনে ছ’টা নাগাদ সুরজিৎ তাঁর মাকে ফোন করে বলে, ‘নাককাটা গলিতে রয়েছি। আমাকে বাঁচাও। আমাকে মারছে।’ এর থেকে বেশি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়।
সুরজিতের বাবা, পেশায় সিইএসসি-র গাড়ির চালক নিরঞ্জনবাবু রবিবার জানান, শনিবার সুরজিতের ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন ছেলে সেখানে নেই। কিন্তু তার রক্তমাখা জামা এবং চপ্পল পড়ে রয়েছে। দেওয়ালে রক্তের দাগ এবং আঙুলের ছাপ। এর পরেই ওই ছাত্রের পরিবারের সদস্যরা অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন বালিগঞ্জ থানায়। খবর পেয়ে পৌঁছয় পুলিশ। নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ-কুকুর।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর থেকেই ওই ছাত্রের দু’টি মোবাইল বন্ধ। রবিবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে একটি ভাঙা সিমকাডর্র্ উদ্ধার করেন এলাকার বাসিন্দারা। পরে সেটি তুলে দেওয়া হয় তদন্তকারীদের হাতে। সিমকার্ডটির মালিক কে, জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানায়, ওই ছাত্রের সঙ্গে এলাকার কয়েক জন যুবকের গোলমাল ছিল। পরিবারের পক্ষ থেকেও এলাকার দুই কিশোরের বিরুদ্ধে ফোনে সুরজিৎকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। ঘটনার পরেই ওই দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে এক জন ঘটনার সময়ে এলাকায় ছিল না বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ।
পুলিশ জেনেছে, ওই ছাত্র শনিবার যে সময়ে তার মাকে ফোন করেছিল, তখন তার মোবাইল টাওয়ার লোকেশন ছিল ভবানীপুর এলাকায়। পুলিশের দাবি, ৬টা ৪২ মিনিট নাগাদ সেখান থেকেই তিনি শেষ ফোনে কথা বলেছিলেন। অথচ পরিবারের দাবি, ওই সময়ে সুরজিৎ বালিগঞ্জ থানা লাগোয়া নাককাটা গলি থেকে ফোন করেছিল।
রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সাদা দেওয়ালের কিছু জায়গায় রক্তের দাগ। তদন্তকারীরা জানান, শনিবার ঘটনার সময়ে ওই ছাত্রের চিৎকার বা কোনও কিছু দেখতে বা শুনতে পাননি স্থানীয় বাসিন্দারা। এক অফিসার রবিবার জানান, সুরজিতের পরিবার যে অভিযোগ করছে, তাতে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। ওই অসঙ্গতি দূর করার জন্য আরও সময় দরকার। ওই ছাত্রের মোবাইলের কল ডিটেলস খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সুরজিতের বাবা নিরঞ্জনবাবু জানান, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে সুরজিৎ ছোট। এক বছর আগে তার বিয়েও হয়েছে। তিনি বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় ছেলের খোঁজ করছি। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও খোঁজ মেলেনি।”
এ দিকে, বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে জ্ঞান হারাচ্ছেন সুরজিতের স্ত্রী চন্দনা মণ্ডল। চন্দনা বলেন, “কিছু দিন ধরেই অচেনা নম্বর থেকে ওর কাছে ফোন আসছিল। কিন্তু ও ধরেই ‘রং নাম্বার’ বলে কেটে দিত। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যেত। রাগও করত।” |