দলেরই কাউন্সিলরদের সঙ্গে পুরপ্রধানের বিরোধ তুঙ্গে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সিউড়ি পুরসভার ৮ বিদ্রোহী তৃণমূল কাউন্সিলরের অনশন চার দিনে পড়ল। কিন্তু রবিবার অবধি উভয়পক্ষের তরজা সমানে জারি আছে। দু’পক্ষই দুর্নীতির অভিযোগে পরস্পরকে বিঁধছেন। এরই মধ্যে আজ, সোমবার অনশনকারীরা সমর্থকদের নিয়ে পুরপ্রধান ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নিয়েছেন।
এ দিন অনশনকারীদের পক্ষে তৃণমূল পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আরও কয়েক দফা অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাঁদের দাবি, উজ্জ্বলবাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও পুরসভার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় প্রশাসনের তরফে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর অবধি করা হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের অন্যতম দীপক দাস বলেন, “২০০২-২০০৫ সালে সিউড়ির পুরপ্রধান থাকাকালীন উজ্জ্বলবাবুর বিরুদ্ধে দুনীর্তির অভিযোগ ওঠে। তৎকালীন জেলাশাসকের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন সিউড়ি থানায় তাঁর নামে একটি এফআইআর করে। ওই মামলায় উজ্জ্বলবাবুকে জামিন নিতে হয়েছিল। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিটও দিয়েছিল।” অভিযোগ, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে উজ্জ্বলবাবুর বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন ওই দুর্নীতির মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
গত কয়েক দিন ধরে অনশনকারীরা উজ্জ্বলবাবুর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম ও বেনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। ওই কাউন্সিলরদের দাবি, জলপ্রকল্প ও বস্তি উন্নয়নে সিউড়ি পুরসভায় কয়েক কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। খোদ পুরপ্রধান নিজের গাড়ি ভাড়া ও হোটেল খরচের লক্ষাধিক টাকার ভুয়ো টিএ বিল জমা দিয়েছেন। পাশাপাশি অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে এবং পুরসভার ট্রাক্টরের জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ভুয়ো বিল জমা দিয়ে জনগণের টাকা লুট করা হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে পুরসভার দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়ার টাকার ক্ষেত্রেও। এমনকী, পিএইচই-র বসানো নলকূপের খরচ দেখানো হয়েছে পুরসভার খাত থেকে। উজ্জ্বলবাবু যদিও বরাবরই অভিযোগগুলি মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এ ধরনের কয়েকটি গুরুতর অভিযোগকে হাতিয়ার করেই দীর্ঘ দিন ধরে সিউড়ির বর্তমান পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে আন্দোলন করছেন ওই ৮ কাউন্সিলর।
গত ১৩ মার্চ পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে তাঁরা অনাস্থা প্রস্তাবও আনেন। অনাস্থা ভোটের ফল দাঁড়ায় ৯-৯। ওই ফলের নিরিখে দীপকবাবুরা উজ্জ্বলবাবুর অপসারণের দাবি করেছিলেন। যদিও তা মানা হয়নি। তার কয়েক মাসের মধ্যেই গত ১৪ ডিসেম্বর জলপ্রকল্পকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগে দলের পুরপ্রধানকে ফের কাঠগড়ায় তুলে বিদ্রোহী কাউন্সিলরেরা চিঠি দেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। চিঠিতে জলপ্রকল্পের উদ্বোধন না করার আবেদনও জানানো হয়। উদ্বোধক হিসেবে পুরমন্ত্রীর কথা জানানো হলেও বিতর্কের পরে তিনি আর সিউড়ি-মুখো হননি। ওই বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের সাম্প্রতিক কর্মসূচি অনশন। এগারো দফা দাবিতে পুরসভা চত্বরে অনশন জারি রেখেছেন দীপক দাস, পূর্ণিমা মাহারা, মহম্মদ শামিমা, প্রীতিকণা ভট্টাচার্য, অমিতা সাহা, তপন সুকুল, উত্তম দাস এবং ইয়াসিন আখতার।
রবিবার অনশনকারীরা উজ্জ্বলবাবুর বিরুদ্ধে আরও দু’টি নতুন অভিযোগ তুলেছেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তপন শুকুল বলেন, “এ বার পুরপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া পরেই উজ্জ্বলবাবু এক নিকটাত্মীয়ের বন্ধুকে নিয়মবর্হিভূত ভাবে ‘রাজার পুকুর’ নামে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি পুকুর লিজে দিয়েছেন। জেলাপরিষদ থেকে শহরের উন্নয়নের জন্য বিআরজিএফ থেকে ১৯ লক্ষ ২২ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকাতেও কোনও কাজ হয়নি। ওই টাকার কী হল, উজ্জ্বলবাবুকে তার জবাব দিতে হবে।”
দলের কাউন্সির হলেও অনশনকারীদের যে কোনও ভাবেই রেয়াত করবেন না, তা শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন উজ্জ্বলবাবু। দলেরই ওই কাউন্সিলরদের আন্দোলনে তিনি বারবার বিড়ম্বনার মুখে পড়ছেন। গোটা ঘটনায় অস্বস্তিতে তৃণমূলও। উজ্জ্বলবাবু অবশ্যই আগেই তাঁর পাশে পেয়েছেন দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। তাই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনিও ক্রমশ নিজের সুর চড়িয়েছেন। এ দিনও অনশনকারীদের উদ্দেশে ফের তোপ দেগে পুরপ্রধান বললেন, “আগের বোর্ড কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে। তার তদন্ত করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই খবর জানাজানি হতেই দীপক দাস ও আগের পুরপ্রধান তপন শুকুলের নেতৃত্বে আমার বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত শুরু হয়েছে।” তাঁর দাবি, কয়েক জন কাউন্সিলরকে ভুল বুঝিয়ে এবং নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে হেনস্থা করার চেষ্টা চলছে। উজ্জ্বলবাবুর কথায়, “দীপক দাস নিজে সিউড়ির পুরপ্রধান হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। কারণ, তিনি কোনও ভাবে পুরপ্রধান হলে ওই সব দুর্নীতির তদন্ত ধাপাচাপা দিয়ে দেবেন।” নতুন অভিযোগ নিয়ে পুরপ্রধানের দাবি, পুকুরটি বহু আগেই লিজ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর আমলে কেবল নিয়ম মেনে লিজের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। অন্য দিকে, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের চার্জশিট নিয়ে উজ্জ্বলবাবু বলেন, “তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এবং কংগ্রেস দল যৌথ ভাবে চক্রান্ত করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়েছিল। বর্তমান প্রশাসন তদন্তসাপেক্ষে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।” |