|
|
|
|
|
কত কথাই তো জানা হল না
বিবেকানন্দ পার্কে ফুচকা খেতে ইচ্ছে করত না? সুপ্রিয়া-সৌমিত্ররা
দিব্যি রয়ে গেলেন অভিনয়ে। তিনি সরে গিয়েছিলেন কেন? সুচিত্রা সেন-কে
ঘিরে অজস্র কৌতূহল। সেই কুয়াশার মধ্যেই হাঁটলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। |
|
জানতাম, সাদা চাদরটা মুখের ওপর থেকে সরে যাবে এক্ষুনিযাঁকে দেখার কৌতূহল সেই ছোটবেলা থেকে, তাঁকে দেখতে পাব আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।
ভাবলাম চোখ বুজে ফেলি। তবু দাঁড়িয়ে থাকি। এই ঘটনায় সাক্ষী হয়ে থাকব তো! আবার ভাবলাম, যদি লোভ সংবরণ করতে না পারি, মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের যুদ্ধে বুদ্ধির যদি হার হয় যদি...চোখ খুলে... না, থাক!
থাক না! তাঁর ইচ্ছেকে সম্মান জানাতেই, মাথা নিচু করে মুহূর্তে, ঘুরে গিয়ে একা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। দেখব না। চাই না জানতে তিনি আজ কেমন দেখতে।
কিন্তু সত্যি কি মনে মনে চাইনি? প্রায় বছর কুড়ি আগে, আমি তখন মুম্বই থেকে কলকাতা এসেছিলাম। মুনদির সঙ্গে আলাপ। একদিন বাড়িতে খেতে ডাকল, তিন-চার জন আমরা। ওই ডাকসাইটে সুন্দরী, মাখনের মতো ত্বক। হাঁ করে দেখতাম। আহা, মুনদি যদি এই রকম হয়, মা তা হলে কী হবেন একবার শুধু বলেছিলাম, তোমার মা কেমন আছেন? পরের বাক্যটা কী আসতে পারে, আন্দাজ করেই মুনদি বলেছিল, “মা কারও সঙ্গে দেখা করতে চায় না রে।” সস্নেহ আদর করেই বলেছিল। যাতে আমি একটুও দুঃখ না পাই। লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার আর বলে ওঠা হয়নি যে, না গো, উনি কেমন দেখতে জানার জন্য আমি অতটা আগ্রহী নই আমার জানতে ইচ্ছে করে ওই অসামান্য ব্যক্তিত্ব যাঁর, সে মানুষটা সামনে থেকে কেমন? কী ভাবে তৈরি করেছেন নিজেকে? ব্যক্তিত্ব এমন একটা ব্যাপার, তা কাউকে দেখে শেখা যায় না। ভাবনাচিন্তা করে আয়ত্তে আনা যায় না। তবুও যদি ওঁর মনটাকে পড়তে পারতাম।
হয়তো সিনেমায় অভিনয় করার কোনও মানসিক বা আর্থিক তাগিদ না-ই অনুভব করতে পারেন মহানায়িকা। কিন্তু একটা স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেকে আড়ালে রাখার মধ্যে মনের জোর, সাহস, অপরিসীম ক্ষমতা লাগে। কোনও দুঃখ ছিল না? কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে না-যাওয়া, বা বিবেকানন্দ পার্কে ফুচকা না খাওয়ার? পরিবারের সকলকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া এ সব ইচ্ছে হত না? নাই বা ছবি তুলতে বা ছাপতে দিতেন। নাহয় পুরনো ছবির সঙ্গে আমরা কিছু ইন্টারভিউ পড়তাম ওঁর। কিংবা হয়তো এ সবই করতেন, কেউ বিশেষ জানতে না পারে, তার সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েই।
কিন্তু কেন? ওঁর লক্ষ কোটি অনুরাগীর মতো আমিও একজন। যে যার মতো করে উত্তর খুঁজছি আমরা সবাই। |
|
শেষের দিকে কেউ কি ওঁকে বলেছিল, “ইস্ বয়স হয়ে গিয়েছে সুচিত্রা সেনের। হিরোইন হিসেবে আর মানাচ্ছে না”। খুব আঘাত পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর ধরে যিনি বাংলা সিনেমার মহানায়িকা হয়ে রাজত্ব করছেন, তাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে কেউ যদি সামান্যতম প্রশ্ন তুলে থাকেন, আঘাত পাওয়ারই কথাখুব অভিমানিনী ছিলেন?
আচ্ছা, উনি কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন নিজের সঙ্গে? কোন অ্যাংগল থেকে কেমন লাগে দেখতে, কোন প্রোফাইলটা বেশি ভাল, তা নিশ্চয়ই নিজে যাচাই করতেন আয়নার সামনে।
তখন সিনেমাটোগ্রাফার-রা হিরোইনদের শট বিশেষত ক্লোজ আপ নিয়ে খুব যত্নশীল থাকতেন। লো- স্পিড লেন্স ছিল। ডিরেক্ট লাইট দিতে হত, প্রিসাইজ লাইটিং হত তার পর ডিফিউজার দিয়ে সফ্ট করা হত। এক নম্বর। দুই নম্বর। আবার তার ওপর সাদা বা কালো নেটবাঁধা থাকত হিসেব। মুখের গড়ন, তাকানো, ঘাড় সোজা বা বাঁকা সব মাপ মতো। সাদা কালোর এক মোহময় জগৎ। ‘হার মানা হার’ দেখতে বসে হঠাৎ কী মজা লেগেছিল। এন টি ওয়ান স্টুডিওর এক নম্বর মেক আপ রুমের সামনের লম্বা জায়গাটা কলেজের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। উনিশ নম্বর ঘরটা ওঁরই ছিল। ঘরে জুতো পরে কারও ঢোকা বারণ ছিল শুনেছি। তা ছাড়া এমনিতেই ওঁর ঘর কেন, উনি যে ফ্লোরে শু্যট করতেন, সেখানে চট করে কেউ নাকি ঢুকতে পারত না। সেই ইউনিটের লোক বা ওঁর খুব চেনা মানুষেরা ছাড়া কেউই ঢুকত না। শুনেছিসবই শোনা কথা। শুনে, পড়ে, জেনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কৌতূহল মিটেছে। এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে আমার প্রথম ঢোকার প্রায় বছর দশেক আগেই উনি নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু যখন পুরোদমে হিরোইন, তখনও তো তিনি নিজেকে আড়ালেই রাখতেন শুনেছি। তার মানে, শুধুই বয়স বা চেহারা প্রধান কারণ নয়, শুধু ‘মিস্ট্রি’ সৃষ্টি করার জন্যও নয়, মানুষটাই হয়তো খুব প্রাইভেট ছিলেন।
তিনি কি ‘সাগরিকা’র মতোই নিজেকে সকলের থেকে তফাতে রাখতেন? নায়িকার জীবন হয়তো কখনও চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অসম্ভব ভাল স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল। তবে শারীরিক গঠন আর ব্যক্তিত্বময় মুখশ্রী চরিত্রগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে সাজাবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছু ছবিতে। সেই সময় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, তার পর সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী মুখোপাধ্যায় এঁরা সকলেই তাবড় অভিনেত্রী ছিলেন। এঁদের প্রত্যেকেরই অভিনয়-ক্ষমতা নানা ক্ষেত্রে সুচিত্রা সেনের অভিনয়-দক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত। আমার সম্পূণর্র্ ব্যক্তিগত ধারণা যে, উত্তম-সুচিত্রা জুটিতে সুচিত্রা সেনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন উত্তমকুমার।
তবে উত্তমকুমার ছাড়া দুটি ছবির নাম এখনই মনে পড়ছে। দুটোই অসিত সেনের। ‘উত্তরফাল্গুনী’ আর ‘দীপ জ্বেলে যাই’সম্পুর্ণ অন্য সুচিত্রা সেনকে দেখতে পাই। ‘দীপ জ্বেলে যাই’য়ের শেষ মিনিট পাঁচেক আবার দেখলাম। এক্ষুনিই। মনে হল, কেন ওঁকে নিয়ে আরও নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করলেন না পরিচালকেরা?
আচ্ছা, উত্তমকুমার তো কাজ করতে করতে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, যদি তা না হত? তিনি কি বেশি বয়সে সবার আড়ালে চলে যেতেন? মনে হয় না। নিশ্চয়ই প্রযোজনা আর পরিচালনা চালিয়ে যেতেন। কি জানি, সবই কল্পনা। আচ্ছা, নিজেদের যাঁরা সম্পূর্ণ ভাবে আড়ালে লুকিয়ে রাখেননি, তাঁরা কি কিছু কম মারাত্মক স্টার? তাঁরা কি কম পূজনীয়? মাধবীদি বা সৌমিত্রদা? ওয়াহিদা রহমান বা অমিতাভ বচ্চন? এঁদের কারও পুরনো সিনেমা দেখতে বসলে আমরা কি ভাবি, ইস্ কেমন দেখতে হয়ে গেছেন এখন! প্রত্যেকটা বয়সেরই একটা আলাদা মাধুর্য আছে তো...
শ্রীমতী সেনের প্রতিদ্বন্দ্বী যদি দু’তিন জন থেকে থাকেন, তা হলে তাঁর মেয়ের ছিল দশ জনের সঙ্গে লড়াই, আর তার মেয়েকে আজ লড়তে হয় অন্তত কুড়ি জনের সঙ্গেকারণ টিভি, ইন্টারনেট, মুম্বইয়ের অভিনেত্রীদের কলকাতায় আনাগোনা সব মিলিয়ে জগৎটা হয়ে গিয়েছে অনেক বড়।
কাগজে দেখলাম দেব লিখেছে, ও-ও এই রকম। নিজেকে এই ভাবে সরিয়ে নেবে একটা সময়ের পর। নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে না। ছেলেমানুষি। তাই এই ভাবনাটা খুব ইউনিক বলে মনে হয়েছে। না, না সবাই যদি এই ভাবে ভাবতে শুরু করে, তা হলে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, ছায়া দেবী এঁদের অভিনীত চরিত্রগুলোর জন্মই হয় না। ভবিষ্যতে যেমন প্রসেনজিৎ, শাশ্বত, রজতাভকে দেখে পরের প্রজন্ম শিখবে। “আমার বাবা বলেন, ভুল করা মানুষের একটা পার্সোনাল অধিকার,” ‘হারানো সুর’ ছবিতে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু জীবনের এত বড় সিদ্ধান্তটা কি ভুল ছিল তাঁর? কোনও দিন কি অনুশোচনা করেননি? হয়তো আমিই ভুল ভাবছি। হয়তো খুবই শান্তিতে আর খুশিতে ছিলেন তিনি।
কত কথাই তো জানা হল না।
কিন্তু এটা তো ঠিক যে, সর্বক্ষণের জন্য নিজেকে বিখ্যাত অভিনেত্রী ভাবা, আর সেই ভাবে জীবনটাকে পরিচালনা করা, এক কঠিন তপস্যা। এই ভয়ানক মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে গেলেন বলেই আজও তিনি এনিগ্মা।
বাঙালি কোনও দিন আপনাকে ভুলবে না মিসেস সেন! |
|
|
|
|
|