সুচিত্রা সেন বিশেষ সংখ্যা
রাঙাদি
ত্তর দশকের মাঝামাঝি। জুহুর সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেলে রয়েছি।
রাঙাদি-র শ্যুটিং চলছে। হঠাৎ করে আমার কাছে এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। তাঁকে দেখেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তখনই আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। উনি শিবাজি গনেশনের সেক্রেটারি। এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, “একটু দেখুন না। শিবাজি গনেশন একটু মিসেস সেনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান।”
আমি গাড়ির কাছে এগিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ির কাচটা নামাতে বললাম। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “শিবাজি গনেশন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। কী বলব?” বিশ্বাস করবেন না, অত ‘ডার্টি লুক’ আমি কোনও দিন পাইনি ওঁর কাছ থেকে। আমাকে বললেন, “বারীন, আমি শ্যুটিংয়ে যাচ্ছি। এ সব কথা কি এখন না বললেই নয়।” আমি গিয়ে শিবাজিসাবের সেক্রেটারিকে বললাম। ভাবলাম মিটে গেছে ব্যাপারটা।
কিন্তু রাতে সেই ভদ্রলোক আবার হাজির। এসে বললেন, “প্লিজ, কিছু করুন। শিবাজি গনেশন ব্রেকফাস্ট টেবিলে পাঁচ মিনিট কথা বলতে চান ওঁর সঙ্গে।” আমি আবার গেলাম রাঙাদির ঘরে। বললাম, এ রকম একটা প্রস্তাব দিচ্ছেন শিবাজি গনেশন, কিছু কি করা যায়? আমাকে আবার বকুনি দিয়ে বললেন, “ধুর্, ধুর্। আমার সময় নেই। ও সব ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমি মিটিং করি না।” ব্যস, আমি আর কথা বাড়াইনি।
এই হচ্ছেন সুচিত্রা সেন। ও রকম নায়িকাও আর কোনও দিন হবে না। ও রকম ব্যক্তিত্বও আর জীবনে দেখতে পাব না।
আমাদের রাঙাদি।
আনন্দplus

মিসেস গাঁধী ও মিসেস সেন: পদ্মশ্রী পাওয়ার পর। সঙ্গে মুনমুন। সৌজন্যে: মুনমুন সেন।
সোজা কলার ধরে জুতোটা খুললেন পা থেকে
আমার সঙ্গে যখন রাঙাদির ছোটবোন রুনা-র বিয়ে হয়, তখন দাঁড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। অসম্ভব সেন্স অব রেসপন্সিবিলিটি ছিল। আমার স্ত্রী ছিল ওঁর সবচেয়ে নেওটা। এত দিন কত প্রেস, কত কিছু জিজ্ঞেস করেছে আমাদের। পাড়াপড়শিরা জিজ্ঞেস করেছে রাঙাদি কেমন, কী করেন? কিন্তু আমরা কোনও দিন মুখ খুলিনি। মুখ খুলিনি বলেই বোধহয় এত ভাল সম্পর্ক থেকে গেছে আমাদের। আজ উনি চলে যাওয়ার পর কত কথাই মনে পড়ছে।
তখন আমরা সবাই মিলে কাশ্মীরে। রোজ গার্ডেনে ‘আঁধি’র শ্যুটিং চলছে। একদিন একটি বাজে লোক হঠাৎ করে ওঁর কাঁধে হাত দিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ দেখি রাঙাদি ঘুরে সেই লোকটার কলার ধরে ফেলেছেন। কলার ধরেই নিজের পা থেকে চটিটা খুলে সপাটে মারলেন। পুরো ইউনিট তখন স্তম্ভিত। এমনই ছিলেন রাঙাদি।

আর কোনও দিন দেরি করেননি সঞ্জীবকুমার
এ তো নয় রাঙাদির রেগে যাওয়ার ঘটনা। মানুষকে শিক্ষা দেওয়ারও আলাদা টেকনিক ছিল সুচিত্রা সেনের। ‘আঁধি’র সময়ের আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সঞ্জীবকুমারের অভ্যাস ছিল রোজ দেরিতে আসা। সে দিন মেহবুব স্টুডিয়োতে শ্যুটিং চলছে। মিসেস সেন স্বাভাবিক ভাবেই আগে পৌঁছে গিয়েছেন।
কিন্তু সঞ্জীবকুমারের দেখা নেই। অনেকক্ষণ পর দেখলাম সঞ্জীবকুমারের গাড়ি ঢুকছে স্টুডিয়োতে। গাড়ি থেকে তখনও নামেননি সঞ্জীবকুমার, হঠাৎ পিছন থেকে রাঙাদি আমাকে ডাকলেন, “উঠে পড়ো গাড়িতে। আমি হোটেলে ফিরব।” বলে হুশ করে বেরিয়ে গেলেন শ্যুটিং থেকে। সে দিনের মতো প্যাক আপ। এর পর আর কোনও দিন দেরি করে আসেননি সঞ্জীবকুমার।

সত্যজিৎ রায়ের ক্লজ মানেনি
আসলে রাঙাদির আশেপাশে সবাই আমরা তটস্থ থাকতাম। বাড়িতে কিন্তু উনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ ছিলেন।
মাদুর পেতে গল্প করতেন। গানবাজনা হত। কিন্তু সেটে ঢুকলেই অন্য রাঙাদি।
কোনও দিন শ্যুটিং চলাকালীন ফোটোগ্রাফার ঢুকতে দিতেন না। পুরোটাই নিজের প্রিন্সিপালে চলতেন উনি।
মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ওঁর মিটিংয়ের কথা। আমরা বাড়ির লোকেরা চাইতাম উনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একটা ছবিতে অন্তত কাজ করুন। একদিন মিটিং ফিক্সড হল। সত্যজিৎ রায় এলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে।
উনি একটা ‘ক্লজ’ বলেছিলেন যে, ওঁর শ্যুটিং চলাকালীন ওই একটা মাস অন্য কোনও শ্যুটিং করতে পারবেন না রাঙাদি। ব্যস্, ওই একটা ক্লজেই আপত্তি ছিল মিসেস সেনের। “ও রকম কোনও ক্লজ থাকলে আমি কাজ করব না। আমার অন্য ছবিগুলোর কী হবে,” বলে মিটিং শেষ করলেন তিনি। আর কোনও দিন দু’জনের কাজ করা হল না।

না রাজসাব, আপনার গল্প পছন্দ হচ্ছে না
কত বার যে এ রকম মিটিং দেখেছি চোখের সামনে। একবার রাজ কপূর দেখা করতে চাইলেন ওঁর সঙ্গে। মুম্বইয়ে আমার সাংবাদিক বন্ধু কলিন পলের মারফত খবর দেওয়া হল আমাকে। আমি বললাম ঠিক আছে। সেই মতো আবার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ড্রয়িং রুমে মিটিং শুরু হল। রাজ কপূর তো নাছোড়বান্দা ওঁকে সই করাবেনই। ম্যাডাম প্রথমে বললেন, গল্প শোনাও। গল্প শোনাতে শোনাতে রাজসাব দেখলাম মাটিতে বসে পড়েছেন। গল্প শোনা শেষ হওয়ার পর বললেন, “আমি এই ছবিটা করতে পারব না রাজসাব। গল্পটা পছন্দ হচ্ছে না।”
ব্যস, মিটিং শেষ।

কিশোরের গল্প শুনে দরজার দিকে ইশারা করলেন
কিশোরের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটল। আমার সঙ্গে কিশোরের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। কিশোরও আমাকে বলেছিল যে, ও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছবি করতে চায়। মিটিং ফাইনাল হল। কিশোরকুমার গল্প বলা শুরু করলেন, অর্ধেকও পৌঁছয়নি গল্প। আমার দিকে ইশারা করে দরজাটা দেখালেন। বুঝলাম আর উনি বসবেন না। আমি কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে কিশোরকে সেখান থেকে বার করলাম। তখনই অবশ্য কিশোর বুঝেছিল গল্প পছন্দ হয়নি বলেই এ রকম করেছি। কিছু মনে করেনি। রাঙাদির ওপর আসলে কেউ রাগ করত না, এমনই একটা শ্রদ্ধা ছিল ওঁর প্রতি সবার।

মালা সরে গিয়েছে... তুমি পরিয়ে দাও রমা
রাঙাদিকে নিয়ে কথা হচ্ছে যখন উত্তমকুমারের কথা হবে না, তা কি হয়? মনে আছে সে দিন উত্তমদা মারা গিয়েছেন। অনেক রাতে আমি পৌঁছলাম বালিগঞ্জের বাড়িতে। বললাম, রাঙাদি তোমার কিন্তু একবার যাওয়া উচিত ওইখানে। আমাকে গম্ভীর ভাবে বললেন, “এত রাতে গেলে মালা পাওয়া যাবে তো?” প্রশ্নটা একদম ঠিক ছিল কারণ সেদিন বিকেল থেকে সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বললাম, তুমি চিন্তা করো না, আমার গড়িয়াহাটে চেনাশোনা আছে।, তুমি শুধু গাড়িতে ওঠো। ওঁকে নিয়ে গড়িয়াহাটে ফুলের দোকানগুলোর কাছে পৌঁছলাম। মালা কিনলাম। কিনে সোজা উত্তম কুমারের বাড়িতে। সুচিত্রা সেন পৌঁছেছেন শুনেই সাঙ্ঘাতিক হইচই তখন। ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন উত্তমকুমারকে। ধীরে ধীরে মালাটা পরিয়ে দিলেন গলায়।
সকাল থেকে এত লোকে মালা দিয়েছে ততক্ষণে যে, মালা দিতেই তা গলা থেকে একটু সরে গেল। ততক্ষণে দেখি গৌরী দেবী চলে এসেছেন। এসে জড়িয়ে ধরলেন রাঙাদিকে।
ধীরে ধীরে বললেন, “মালাটা সরে গিয়েছে। তুমি ঠিক করে পরিয়ে দাও রমা।” ঘর ভর্তি লোকের তখন চোখে জল।

স্টেজে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইছেন উত্তম-সুচিত্রা
এত দিন বহু কথা জমে ছিল। কিন্তু কোনও দিন কাউকে কিছু বলিনি আমরা কারণ রাঙাদি পছন্দ করতেন না। কত বার হয়েছে আমার দুই মেয়ে লগ্না আর তৃণা ওদের মাসির সঙ্গে কালী ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। কত আড্ডা মেরেছি আমরা সবাই মিলে! তখন আমি রেগুলার শো অর্গানাইজ করাই। আজ রফি, কাল কিশোর, পরশু লতা। এমনও হয়েছে স্টেজে আমি বলাতেই উত্তম-সুচিত্রা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ সিনটা অভিনয় করেছেন, বাইকে বসে নিজেদের গলায় গানটা গাইতে গাইতে। তখন স্টেজে দাঁড়িয়ে মিউজিক কনডাক্ট করেছেন হেমন্তদা।

তুমি মীনাকে বোলো, আমি শ্যুটিং ক্যানসেল করতে পারব না
সেই সব দিনের কথা আজকে রূপকথা মনে হয়। মনে আছে ‘মমতা’র শ্যুটিং চলছে। হঠাৎ করে ধর্মেন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন ধর্মেন্দ্রর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মীনাকুমারী। মীনাকুমারী আমাকে বললেন, “আপনি মিসেস সেনকে বলুন এই শ্যুটিংটা পিছোতে হবে।” আমি গিয়ে বললাম সেই কথা।
শুনেই বললেন, “আমার ডেটের ওলটপালট হয়ে যাবে। তুমি মীনাকে বোলো সেটা।”
রাঙাদির ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল, উনি কিছু অনুরোধ করলে কেউ ফেলতে পারত না। তখন একসঙ্গে সতেরোটা ছবির শ্যুটিং ক্যানসেল করেছিলেন ধর্মেন্দ্র। একমাত্র করেননি ‘মমতা’র। এটাই ছিল রাঙাদির ম্যাজিক।

কেউ মিসকোট করলে বিরক্ত হতেন খুব
মাঝেমাঝে মনে হত, যে-মানুষটা বাড়িতে এত দয়াময়ী, সে কী করে সেটে কি বাইরের লোকেদের কাছে অন্য মানুষ হয়ে যায়? প্রেসের ব্যাপারেও রাঙাদি ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। মনে আছে রাঙাদির খুব ভাল বন্ধু ছিলেন অসিত চৌধুরী। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর অসিত চৌধুরী আমাকে অনুরোধ করেছিলেন সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্তকে নিয়ে যেতে ওঁর কাছে। আমি সেবাদাকে নিয়ে যাই বালিগঞ্জের বাড়িতে। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন রাঙাদি। সেবাদা বেশ বড় একটা লেখাও লিখেছিলেন। কিন্তু সে দিন বেরোবার আগে রাঙাদি একটাই কন্ডিশন রেখেছিলেন, লেখাটা যেন ছাপার আগে তাঁকে দেখিয়ে নেওয়া হয়। কেউ তাঁকে মিসকোট করলে একদম সহ্য করতে পারতেন না। বিরক্ত হতেন খুব।

কন্যা লগ্নার সঙ্গে বারীন ধর।
রাঙাদির সঙ্গে বেশি ইন্টিমেসি করেছ তো মরেছ
আজকে উনি আর নেই। আমার স্ত্রীর খুব মন খারাপ, আমার মেয়েরাও তাদের মাসির খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। লগ্না তো প্রায়ই অফিস থেকে বেরিয়ে মাসির সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরত। ওদের সঙ্গে রাঙাদি গল্প করত, জিজ্ঞেস করত আমাদের সব খবর।
কিন্তু এত আন্তরিকতার মধ্যেও ওঁর ব্যক্তিত্বটা সব সময় বেরিয়ে আসত। আর ওই ব্যক্তিত্বের সামনে কোনও কথাই চলত না। একবার ওড়িশার এক বড় ব্যবসায়ী শো-য়ের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ওদের একটা ফাংশন করতে হবে, যেখানে রাঙাদি থাকবেন আর মুনমুন থাকবে। তখনকার দিনে দশ লাখ টাকা অফার করল। আমি বলতেই রাঙাদি বললেন, “তুমি মুনমুনকে বলো যেতে। আমি যাব না।”
আমার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক থাকার দরুন বহু মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করতেন উনি মানুষটা কেমন ছিলেন? আমি তাঁদের একটা কথাই বলতাম, রাঙাদির বেশি ঘনিষ্ঠ হোয়ো না।
বেশি ইন্টিমেসি যাঁরাই করতে গিয়েছেন, তাঁরাই চক্ষুশূল হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গেই ওঁর সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছে।
সারা জীবন সবার থেকে আলাদা থেকে গেলেন তিনি।
বাঙালির সুচিত্রা সেন।
আমাদের রাঙাদি।
একদম ‘হ্যান্ডল উইথ কেয়ার’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.