ন্যূনতম মজুরি মিলছে না। শ্রম দফতরের খাতায় নাম নথিভূক্ত করাতে গেলে পড়তে হচ্ছে দালালদের খপ্পরে। মিলছে না কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধে। ক্ষুব্ধ বিড়ি শ্রমিকরা তাই এলেন না সরকারি শ্রমিক মেলায়। দিনভর অপেক্ষা করেও জেলার আড়াই লক্ষ বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে একজনও মেলায় না-আসায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন শ্রম দফতরের কর্তারা।
শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু শনিবার মেলা উদ্বোধন করতে এসেছিলেন মালদহে। তাঁর অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরই দলের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, সাবিত্রী মিত্র। এদিন শ্রমিক মেলায় শ্রমমন্ত্রীর সামনেই সাবিত্রীদেবী বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের তোলা অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, “বিড়ি শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করাতে টাকা চাওয়া হচ্ছে। আমি শ্রমমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, ওই হেনস্থা রুখতে বিড়ি শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তির অফিস কালিয়াচক থেকে মালদহ শহরে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।” শ্রমমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, তৃণমূল সরকার আসার পরে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে আড়াই গুণ।
শনিবার মালদহে শুরু হল রাজ্যের প্রথম শ্রমিক মেলা। শ্রমিকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধে সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করতেই এই মেলা। মালদহে অসংগঠিত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ বিড়ি বাঁধেন। সিটু, আইএনটিইউসি, ইউটিইউসির প্রভৃতি শ্রমিক সংগঠনের জেলা নেতৃত্বের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন দাবি জানানোর পরেও রাজ্য সরকার বিড়ি শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি (হাজার বিড়িতে ১৬৯ টাকা) নিশ্চিত করেনি। শ্রমিকরা পাচ্ছেন ১০০ টাকা করে। এর প্রতিবাদেই বিড়ি শ্রমিকরা আসেননি মেলায়, দাবি করলেন সিটু-অনুমোদিত জেলা বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের সহসভাপতি ইন্দ্রজিৎ মিত্র, ইউটিইউসির জেলা সম্পাদক দুন্দুভি সাহা, এবং আইএটিইউসির জেলা সভাপতি কাজী নজরুল ইসলাম। |
তৃণমূল শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিটইউসির জেলা সভাপতি মানব বন্দোপাধ্যায়ও বলেন, “বিড়ি শ্রমিকদের শ্রমিক মেলায় আসার জন্য গতকাল অনেক অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেউ মেলায় আসতে রাজি হননি। একজনও বিড়ি শ্রমিক মেলায় হাজির হননি। চেষ্টা করেও ওঁদের শ্রমিক মেলায় আনতে পারিনি।”
এ দিন দুপুরে মালদহ শহরের রামকৃষ্ণ কলোনির মাঠে শ্রমিক মেলায় গিয়ে দেখা গেল, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, রেশম শিল্প, বস্ত্র শিল্প, এমনকী জেলা পুলিশ, স্থানীয় ব্যাঙ্কের স্টলেও ভিড় জমেছে। কিন্তু একেবারেই শূন্য ‘বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ’ স্টলটি। জেলা শ্রম দফতরের সহকারী শ্রম কমিশনার দেবু কর বলেন, “বিড়ি শ্রমিকদের জন্য একটি স্টল খোলা হয়েছিল। কিন্তু একজনও বিড়ি শ্রমিক হাজির হননি। বিড়ি শ্রমিকরা না-আসায় দফতরের কর্মীদের বিড়ি শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত স্টলে বসিয়ে রেখেছি।”
কিন্তু বিড়ি শ্রমিকদের দাবি নিয়ে কেন উদ্যোগী নয় সরকার? দেবুবাবুর দাবি, ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার জন্য গত দুই মাসে জেলার ৩০ টি বিড়ি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে শ্রম দফতরের পক্ষ থেকে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও মালিকরা বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াচ্ছে না।
বিড়ি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পূর্ণেন্দবাবু বলেন, “আগে তো বিড়ি শ্রমিকরা এক হাজার বিড়ি বাঁধলে ৫৫ টাকা পেতেন। আমরা ক্ষমতায় আসার পর বিড়ি মজুরি ১০০ টাকা করেছি। এত কম সময়ে এর বেশি কী করতে পারি?” তাঁর দাবি, প্রচুর বেআইনি বিড়ি বাইরে সরবরাহ হচ্ছে। সেই বেআইনি বিড়ি সরবরাহ রুখতে হবে। নইলে বিড়ি শ্রমিকরা বঞ্চিত হবেন।
অসংগঠিত ক্ষেত্রে মালদহ জেলায় বিড়ি শিল্পে কাজ করেন আড়াই লক্ষ শ্রমিক। জেলার কালিয়াচক, মানিকচক, ইংরেজবাজার, রতুয়া, হবিবপুর, চাঁচল, হরিশ্চন্দ্রপুরে এই বিড়ি শ্রমিকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এঁদের প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলা। কিন্তু সরকারি খাতায় নাম নথিভূক্ত করাতে পারেননি অন্তত ৭৫ হাজার বিড়ি শ্রমিক। কেন? শ্রমিকদের বক্তব্য, জেলায় কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের একটিমাত্র অফিসে বিড়ি শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সেটি কালিয়াচকের বালিয়াডাঙ্গায়। হরিশ্চন্দ্রপুর, চাঁচল, বা রতুয়া থেকে সেখানে বিড়ি শ্রমিকদের যাতায়াতে অত্যন্ত অসুবিধা।
তার উপর রয়েছে দালালচক্র। পুরাতন মালদহের সাহাপুরের সবিতা সরকার, আলো মন্ডলরা বলেন, “নাম নথিভুক্ত করাতে কালিয়াচকে গিয়ে তিন বার ফিরে এসেছি। নাম লেখাতে দালালরা এক হাজার টাকা চাইছে। এত টাকা কোথায় পাব?” দশ বছর ধরে বিড়ি বেঁধেও বিড়ি শ্রমিক হিসাবে নাম নথিভুক্ত করাতে পারেননি তাঁরা।
এর ফলে সবিতা, আলোর মতো ৭৫ হাজার বিড়ি শ্রমিকের পরিবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়ি তৈরির অনুদানের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নানা শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে বহুবার ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে, কালিয়াচক থেকে শ্রম দফতরের অফিস মালদহ শহরে সরানো হোক। ফল হয়নি।
কালিয়াচকের আলিনগরের হসিনা বিবি, সাকেয়া বিবিরা বলেন, “ঠিকাদাররা আমাদের বিড়ির পাতা ও মশলা দেয়ে যায়। এক হাজার বিড়ি বাঁধলেও ওই ঠিকাদাররা ১০০ টাকা মজুরি দিচ্ছে। ১৬৯ টাকা মজুরি চাইলে ঠিকাদাররা হুমকি দেয়, ১০০ টাকায় হাজার বিড়ি বাঁধলে বাঁধ, না হলে তোদের দিয়ে বিড়ি বাঁধাবো না। অন্য জায়গায় বিড়ি বাঁধাব। পেটের টানে কম টাকায় বিড়ি বাঁধছি।” |