বার্লিন জু-তে সবচেয়ে আদরে থাকে হাতিরা। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ পেরোতেই আশপাশের মানুষরা চিড়িয়াখানার দরজায় হাসিমুখে লাইন দেন। হাতে অ্যাত্ত বড় বড় লাল-নীল বাক্স। তাতে থাকে হাতিদের জন্য ক্রিসমাস প্রেজেন্ট। ২৫ তারিখ গির্জার ঘণ্টা দোলে আর চিড়িয়াখানায় হেলতেদুলতে আসেন মোটাসোটা এক সান্তা ক্লজ। উপহারের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে যেই না হাতিদের ও-দিকটায় গেছেন, হাতিরা লম্ফ দিয়ে এসে র্যাপার কাগজ খচরমচর ছিঁড়ে প্রেজেন্ট বের করেই খেয়ে ফ্যালে। সবই যে টাটকা পাইন গাছ।
লন্ডনের ব্রংক্স চিড়িয়াখানায়, হাতিরা যখন তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুতে কেঁদে ভাসিয়ে ডিপ্রেস্ড, তাদের ডেরায় বসিয়ে দেওয়া হল পেল্লায় আয়না। তার পর আর কী, সারা দিন এ-ওকে ধাক্কা মেরে চব্বিশ ঘণ্টা ঠায় আয়নার সামনে। সাইবেরিয়ায়, যখন মাইনাস চল্লিশ চলছে আর সার্কাসের দুটো হাতি একেবারে কাবু, শুঁড়ে কানে মস্ত মস্ত ফ্রস্টবাইট, পাশের এক চিড়িয়াখানার পরামর্শে, গরম জলে একটু ভদকা মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হল। ব্যস। বাছাধনেরা এমনি গরম হয়েছিল, টারজানকে চ্যালেঞ্জ করে লাফাচ্ছিল। এই ফর্মুলা মেনেই কাজাখস্তানের কারাগান্ডা চিড়িয়াখানায় মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি হতেই বাঁদরদের কান পাকড়ে কেটলিতে করে ওয়াইন খাইয়ে দেওয়া হয়। তাই নিয়ে ভয়ানক শোরগোল! অন্য দেশের ডাক্তাররা বললেন, ওই চিড়িয়াখানার লোকজন চিরকালই যা-তা, এক বার চাঁদা তুলবে বলে পশুপাখিদের বিউটি কনটেস্টও করিয়েছিল!
|
এক অগস্টে আমেরিকার ‘স্টার ফ্যামিলি সার্কাস’-এর নামে ঢিঢি। তারা বেঁটে ক্লাউন আর লম্বা ক্যাঙারুর বক্সিং ম্যাচ দেখাত। ক্যাঙারুটা এলেই ‘রকি’ সিনেমার থিম বাজত, তাকে লাল বক্সার শর্টস আর গ্লাভ্স পরিয়ে সিলভেস্টার স্ট্যালোন লুক-ও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পশুপ্রেমী সংঘ-রা ভয়ানক চেল্লামেল্লি জুড়লেন। ব্যাপারটা মোটেই মজার নয়। বরং বেশ নিষ্ঠুর, কেমন যেন গ্ল্যাডিয়েটর গ্ল্যাডিয়েটর গন্ধ। চিড়িয়াখানার মালিক বললেন, জ্যাক তোফা থাকে, সাত মাস এসি-গাড়িতে ঘুরে শো করে, বাকি পাঁচ মাস ছুটি, তখন নিজের মনে লাফিয়ে বেড়ায়। কিন্তু ঝগড়া বাড়তেই লাগল। সংগঠনরা গাবদা খাতা বের করে দেখালেন, ষাটের দশকে বক্সার ক্যাঙারুরা আমেরিকার দিকে দিকে লড়ে বেড়াত, টিভিতেও শো করত। কিন্তু এত ঘোরাঘুরি, স্ট্রেস সবাই সহ্যই করতে পারল না। দুজন বেঘোরে মরে গেল। সেই থেকে ক্যাঙারু বক্সিং বহু দিন বন্ধ। এখন ফের এ সব কারবার শুরু করা কেন?
সার্কাস বা চিড়িয়াখানায় অনেক সময় বাঘ-সিংহরা জন্মেই ‘অনাথ’ হয়ে যায়। তাদের বাবা-মা, কেন কে জানে, তাদের তাড়া করে। তখন সেই জনমদুখি ভগ্নস্বাস্থ্য শ্বাপদ-শাবককে সন্তানস্নেহে পালন করে মহানুভব জিমি ও বাঘাগণ। বিদেশি চিড়িয়াখানার হাসপাতালে তাই কুকুর ও বাঁদরদের খুব খাতির। অসুস্থ শিশু-পশুদের শুশ্রূষা করে তাদের ফিটফাট করে তোলে কুকুররা। আর বাঁদররা চুলকে চুলকে তাদের সব ময়লা পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু, ধিক প্রকৃতি। স্বাস্থ্য ফিরিয়ে এরা খাঁচায় ফিরে গেলে, কুকুর ধাই-মা বা বাঁদর আংকল দেখা করতে এলে, ইয়াব্বড় হাঁ!
তবে সোয়াস্তি, সবাই এক রকম হয় না। ওয়ারশ জু’তে দেখবেন একটা ছুঁচলো-মুখ নেকড়ে আর একটা পাহাড়ি ছাগল একসঙ্গে খেলা করছে। আবার পানামা সিটির সামিট জু’তে গেলেই সবাই অ্যালিগেটর সার্কল-এ ছোটে। সেখানে এক কালোমুখ কুমির এক বয়স্ক কচ্ছপকে পিঠে বসিয়ে সারা ঝিল ঘুরে বেড়ায়। টেক্সাসে এক নেকড়ে আর ভাল্লুক একই খাঁচায় জয়-বীরু লাইফ কাটায়। ওদের আলাদা রাখার চেষ্টা চলেছিল, কিন্তু রাতের পর রাত বিরহ-ধ্বনিতে হাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
হিউস্টন জু-তে, খাঁচার চিতাগুলো দিন-দিন মোটকা হচ্ছিল, খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে। কর্তারা পার্কে একটা বড় জায়গা তার-ফার দিয়ে ঘিরে, সবুজ রেসিং টার্ফ বসিয়ে দিলেন। তার পর চিতাগুলোকে বকে বকে সেখানে দৌড় করাতে লাগলেন। ক’দিনেই চিতাদের মেদ সব ঝরে গেল, নতুন ‘জিম’ও দিব্যি পছন্দ!
অস্ট্রেলিয়ার চিড়িয়াখানায় একটা ছোট কুমির, সব গার্লফ্রেন্ডকেই ঘ্যাঁকঘ্যাঁক কামড়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল। এক দিন মাঠ থেকে লোহার ঘাস-কাটা যন্ত্রটা নিয়ে সটকাল। দাঁতালো জিনিস তো, আর এক গার্লফ্রেন্ড ভেবে থাকবে। বুঝল, যখন তাকেও কামড়াতে গেল। দু-দুটো দাঁত পড়ে গেল তক্ষুনি।
এক শয়তান পাইথন সম্রাট থাকে ইন্দোনেশিয়ার সাপ-ঘরে। বেশ বিখ্যাত। তাকে এক বার আস্ত গরু ভেট দেওয়া হয়েছিল। বজ্জাতটা পেট ফুলিয়ে বেশ মটকা মেরে পড়ে ছিল। তার পর যেই না দর্শনার্থিবৃন্দ এসে তাকে ঘিরে খচাখচ ফ্ল্যাশ, মওকা বুঝে ওয়াআক্ক্! আধ-হজম গোটা গরুটাই দর্শকদের ঘাড়ে উগরে দিল!
চিনের হুবেই চিড়িয়াখানায় গেলে কান চাপা দিতে হবেই। সেখানেই সেই ময়নাটি থাকে, যে ২০১২-র নিউ ইয়ারের সময় বাছাই বাছাই গালিগালাজ করে খুব নাম করেছিল। কোনও ক্যাপ্টেন হ্যাডকের বংশধর ওকে ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণরাধে’-র বদলে ভুলভাল জিনিস শিখিয়ে দিলে তার কী অপরাধ? কিন্তু পাখিটাকে একঘরে করে দেওয়া হল! আর পাখিদের ঘরের সামনে বোর্ডও ঝুলল: ময়নাদের কটু কথা শেখানো নিষেধ।
তবে, ওখানে কতকগুলো চিড়িয়াখানা পশুপাখিদের সুখদুঃখটা বোঝে। ওগুলো সাফারি কাম জু। অর্থাত্, যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীদের থাকতে দেওয়া হয়। অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছপালা খড়-টড় সাজিয়ে, পুকুর ইত্যাদি খুঁড়ে, বেশ হালকা জঙ্গল মতো বানিয়ে রাখে। পশুপাখিরা জানতেও পারে না যে আসলে তারা বন্দি। এমনকী শিকার করাও প্র্যাকটিস করানো হয়। জিপ নিয়ে লোক ঢোকে খাবার দিতে। ওই জিপ দেখলেই বাঘ-টাঘ’রা হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসে। এ বার কায়দা করে দরজা খুলে জ্যান্ত গরু-মোষ মুরগা-সুর্গা ছুড়ে দেওয়া হয়। বাঘের দল খানিক শিকার ধরা প্র্যাকটিস করে, তার পর তাদের ঘাড় মটকায়।
বিশ্বব্যাপী চিড়িয়াখানায় উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানা, আলিপুর জু-ও পিছিয়ে নেই। এখানে শুধু ক’টা হাড়জিরজিরে খ্যাঁকশেয়াল আর ভালমানুষ বাঘ-ভাল্লুকই তো বিশেষ দ্রষ্টব্য নয়। তাদের দেখতে যারা আসে তারাও তো হাঁ করিয়া দেখিবার পদার্থ। এরা এসেই জ্বলজ্বলে নোটিস আর রক্তচক্ষু উর্দিওলাদের মস্ত একখান কাঁচকলা দেখায়। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গলে যাওয়া চকোলেট বার করে ছেলেকে বলে, ‘বাবু, দাও’।
বিশ্রামরত কুমিরকে তখন লালমোহনবাবু ঠাউরে বাবু লজেন্স আর ক্যাডবেরির ছোরা মারা প্র্যাকটিস করে। বাঁদর দেখলেই সব্বাই সপাটে ইট ছুড়ে মারে। সিংহ আপনমনে উঠে গাছে দু’পা ভর দিয়ে একটু দাঁত-নখ শানাতে গেলেই চিড়িয়াখানা ইডেন গার্ডেনস! সিক্সার-সুলভ হোহোহোয়ায়ায়ায় তাকে ভড়কে দেয় এবং প্রাইজস্বরূপ ডায়েট কোকের ক্যান ছোড়ে। বাংলার বাঘকে মোবাইল বাজিয়ে ‘এক থা টাইগার’-এর গান শোনায়!
এদের ক্যালি এরকমই অপরিসীম, ছেলেমেয়েকে পইপই করে শিখিয়েছে পশুপাখিদের সঙ্গে শেয়ার না করে কক্ষনও চিপ্স একলা একলা খাবে না। আচার দিয়ে রুটি তরকারি খেলে বেবুনকেও ভাগ দেবে। তাই তারা যখন বাড়ি গিয়ে ‘চিড়িয়াখানায় এক দিন’ রচনা লেখে, বেবুনটি পেটের ব্যথায় কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে ছোটে। একটা হরিণ স্নেহের আতিশয্যে সোজা স্বর্গে চলে গিয়েছিল। মৃত্যুর পর নিয়মমাফিক পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে ডাক্তারবাবু থতমত। জীবটির অন্ত্র ও পাকস্থলী প্লাস্টিকে পরিপূর্ণ। কলকাতা চিড়িয়াখানার আসলি দেখনেওয়ালি চিড়িয়া তো এই বাঘের-গলায়-মালা-পরানো পাবলিক। হায়, এদের নিয়ে কোনও ‘বিলিভ ইট অর নট’ লেখা হয় না! |