পুপুলকে ঘরে ঢুকতে দেখে মা চমকে গেল, ‘এ কী রে, ওইটুকু একটা বাচ্চা! কোথায় পেলি?’
‘ওর মায়ের রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় রাস্তায়। মায়ের পাশে শুয়ে কুঁইকুঁই করে কাঁদছিল। এত মায়া লাগল, তাই তুলে নিয়ে এলাম।’
‘এ ভাবে আনা যায় নাকি? যা যা, যেখান থেকে এনেছিস সেখানেই রেখে আয়।’
মায়ের কথায় পুপুলের চোখে জল এসে গেল, ‘না, কিছুতেই না। ও আমার কাছেই থাকবে। আমি ওকে বড় করব। তুমি আমাকে একটু দুধ দাও তো, ওকে খাওয়াই।’
‘তার পর?’ মা তো রীতিমতো চিন্তিত, ছেলে বলে কী?
‘তার পর তুমি ওকে চান করিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেবে।’
‘আমি পারব না পুপুল। জীবনে আমি ও সব করিনি। জানিও না।’
‘কেন, আমি বাচ্চা থাকতে তুমি বুঝি আমাকে কখনও চান করাওনি?’
‘তোকে চান করানো আর একটা কুকুরছানাকে চান করানো এক হল?’
পুপুল কুঁইকুঁইকে কিছুতেই ছাড়বে না। হ্যাঁ, পুপুল কুকুরছানাটার নাম রেখেছে কুঁইকুঁই। সব সময় আগলে রাখে। ওকে খাওয়ায়, চান করায়, পাউডার মাখায়। পাশে নিয়ে শোয়। ছড়া বলে ঘুম পাড়ায়।
কুঁইকুঁই যা বলে সব নাকি পুপুল বুঝতে পারে। কুঁইকুঁইয়ের এখন খিদে পেয়েছে মা, খেতে চাইছে। দুধ দাও। কুঁইকুঁই এখন বেড়াতে যাবে বলছে মা, ওকে বেড়িয়ে আনি।
কুঁইকুঁই এই বলছে, কুঁইকুঁই ওই বলছে, এই করতে করতে পুপুল সর্বক্ষণ নিজে অস্থির। বাড়ির অন্য সবাইকেও অস্থির করে রেখেছে।
মা তো রাগে গজগজ করছে সব সময়। কিন্তু রাগ করে আর কী করবে। ছেলের বায়নায় কুকুরছানার জন্য বাস্কেট এসেছে। ছোট কাঁথা এসেছে। নরম বালিশ এসেছে, আরও কত কী!
দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে গেল। একটু বড় হয়ে গিয়েছে ছানাটা। ওর ডাকের ধরনটা বেশ পালটেছে, এখন আর কুঁইকুঁই করে ডাকে না। কিন্তু তাতে কী, ওর নাম পালটায়নি পুপুল। আদর করে পুরনো নামেই ডাকে। আর সেও যে কী আহ্লাদে হয়েছে তা আর বলার নয়। সে এখন তার প্রভুর কোলে বসে দুধ-ভাত খায়। টোস্ট খায়, বিস্কুট খায়। |
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য। |
মা প্রথম থেকেই বলে দিয়েছে পুপুলকে, ‘ও যদি আমার ঘরবাড়ি নোংরা করে তা হলে কিন্তু আমার রাগ দেখবে তুমি!’
‘কিচ্ছু নোংরা করবে না। ওকে আমি এমন ট্রেনিং দেব যে আমাদের মতো বাথরুমে গিয়েই পটি করে আসবে। দেখো না, বারান্দার ঘেরা জায়গায় টুল পেতে আমি যে ওর ডাইনিং টেবিল বানিয়ে দিয়েছি, ও শুধু সেখানে বসেই খায়। খাবার দিয়ে ঘর নোংরা করে? তোমাদের বিরক্ত করে? শুধু আমার হাতেই খায়। এমনকী নিজের বাসনটাও চেনে ও। তুমি অন্য প্লেটে খাবার দিয়ে দেখো তো, খাবেই না কুঁইকুঁই।’
তা অবশ্য ঠিক। একটা ব্যাপার দেখে পুপুলের মা অবাক হয়ে গিয়েছে, খুশিও। কুঁইকুঁই আসার পর থেকে ক্লাস এইটের পুপুলবাবু দারুণ ডিসিপ্লিনড হয়ে গিয়েছে। সে এখন খাওয়া নিয়ে বায়না করে না, সময় নষ্ট করে না। খাবার ফেলেও না। কুঁইকুঁইকে ট্রেনিং দিতে দিতে নিজেও খুব গোছালো হয়ে গিয়েছে। কুকুরছানাটিকে নিয়ে পুপুল যেমন মত্ত হয়ে গিয়েছে, তেমন শান্তও হয়ে গিয়েছে। দেরি করে বাড়ি ফেরে না। এখানে ওখানে খাওয়ার বায়না নেই। টিভি দেখাও বেশ অনেক কমে গিয়েছে। কুঁইকুঁইকে যে অনেক সময় দিতে হয় এখন। পড়াশোনাতেও বেশ মনোযোগী হয়েছে পুপুল। তার রেজাল্ট যদি খারাপ হয়, সেই তো দোষ পড়বে কুঁইকুঁইয়ের ওপর! বাবা তো প্রথম থেকেই বলে আসছেন, ‘ওই পোষ্য নিয়ে মেতে থাকলে পড়াশোনায় ডাব্বা খাবে তুমি।’ এ কথা সে সত্যি হতে দেবে না। হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় ও থার্ড হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কুঁইকুঁইকে কোনও ভাবেই অপবাদ দেওয়া যাবে না।
এক দিন পুপুলের মা বলল, ‘প্রায় দু’মাস তো হয়ে গেল, তোর শখ তো মিটেছে, এ বার ওকে ওর জাত-ভাইদের কাছে দিয়ে আয়।’
‘কোথায় আছে ওর বাবা-মা, ভাই-বোন, কী করে জানব?’
‘ও তো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা। রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়ে এলে নিজেই ও পরিজনদের খুঁজে নেবে।’
‘না, না, মা, ও আমার কুঁইকুঁই। আমরাই ওর পরিজন। ওর মা হয়তো সে দিন অ্যাকসিডেন্টে মরেই গিয়েছে। বাবাই-বা ওর কে?’
‘ওর বাবা হয়তো ওকে অনেক খুঁজেছে। কষ্ট পেয়েছে আর কেঁদেছে। ওর ভাই-বোন, বন্ধুরা হয়তো ওকে খুব মিস করে। মনে মনে কুঁইকুঁইও হয়তো ওদের মিস করে।’
‘আমি ওকে এত ভালবাসি, এত যত্ন করি, তাও ও ওদের মিস করে?’
গম্ভীর হয়ে যায় মা, বলে ‘আচ্ছা পুপুল, কেউ যদি তোকে নিয়ে গিয়ে খুব ভালবেসে তার কাছে রেখে দেয়, আমাদের চেয়েও বেশি যত্ন করে, তুই আমাদের মিস করবি না?’
কথাটা শুনে চুপ করে থাকে পুপুল, উত্তর দেয় না। মায়ের চেয়েও বেশি গম্ভীর হয়ে যায়।
‘ভালবাসা দিয়ে আটকে রাখতে নেই, স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেওয়াই আসল ভালবাসা, পুপুল।’
মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল পুপুল। বুঝেও যেন বুঝতে পারল না। কান্নাটা গলায় এসে আটকে রইল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল না।
কিছু দিন ধরে কুঁইকুঁই মন মরা হয়ে আছে। আগের মতো লাফায় ঝাঁপায় না। বল নিয়ে খেলে না। শরীরটা যেন খারাপই ওর। পুপুল ওর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘কুঁইকুঁইয়ের গা-টা কেমন গরম মা। ওর নিশ্চয়ই ভাইরাল ফিভার হয়েছে।’
‘তা হলে তো ডাক্তার
দেখানো দরকার।’
‘ডাক্তার সেনকে এক বার ফোন করে কল দেবে, মা?’
মা হেসে বলল, ‘পাগল ছেলে, ডাক্তার সেন তো তোর ডাক্তার। আমাদের হাউস ফিজিশিয়ান, উনি কী করে কুঁইকুঁইকে দেখবেন? ওকে কুকুরের ডাক্তার দেখাতে হবে।’
‘ও।’ বলে পুপুল বেরিয়ে গেল। খানিক পর ঘুরে এসে বলল, ‘মা, কুঁইকুঁইকে নিয়ে ভেটেরেনারি কলেজ হাসপাতালে যাব। ওখানে ওর ডাক্তারকে পাওয়া যাবে। আমি চিনি ওই হাসপাতালটা, বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের পাশে।’
‘সে তো চিনিস। নিয়ে যাবি কী করে?’
‘কেন অটোয় চলে যাব।’
খুব যত্ন করে কোলে নিয়ে অটোয় পুপুল একাই কুঁইকুঁইকে নিয়ে ভেটেরেনারি হাসপাতালে এল। ডাক্তার বেশ যত্ন করে দেখলেন। তেমন কিছুই হয়নি ওর। ডাক্তার পুপুলকে কয়েকটি দরকারি কথা বলছিলেন, কোল থেকে কুঁইকুঁইকে পাশে নামিয়ে রেখেছিল পুপুল। কথা বলা শেষ হয়ে গেলে পাশে তাকিয়ে দেখে কুুঁইকুঁই নেই!
‘কোথায় গেল’, ‘কোথায় গেল’, করে পুপুল ব্যস্ত হয়ে কুঁইকুঁইকে খুঁজতে লাগল। এত বড় বাড়ি, কোথায় গেল সে? হারিয়ে ফেলল সে তার কুঁইকুঁইকে?
হঠাত্ পুপুলের চোখ পড়ল হাসপাতালের বাইরের ছোট মাঠটায়।
সেখানে আরও তিন-চারটে কুকুরছানার সঙ্গে কুঁইকুঁই দারুণ খেলা জমিয়েছে। কী খুশি সে! আর একটুও মনমরা ভাব নেই। ভাইরাল
ফিভার-টিবার সব ভ্যানিশ।
পুপুল সেখানে গিয়ে দাঁড়াল, ‘এই কুঁইকুঁই, চল-চল, বাড়ি যাবি না? |