হোলুইগানে এল কামদুনি, মধ্যমগ্রাম
পৌষের পড়ন্ত বিকেলে রাখাল বালকের দল দ্রুত পা চালায় বাড়ির পথে। গেরস্থালির কাজ সেরে ফেলেন মহিলারাও। সন্ধ্যা নামতেই বাতাসে ভেসে আসে খোল-করতাল-হারমোনিয়ামের আওয়াজ। গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে জমিয়ে বসে গানের আসর। কিন্তু এ কী গাইছেন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ওই লোকগায়কেরা?
‘শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন/ বঙ্গের নারী নির্যাতনের কথা করিব বর্ণন/ রাজনীতি, দলাদলি যত বেশি বাড়ে/ বঙ্গনারীর ইজ্জত তত বেশি কাড়ে।’ মূল গায়েন থামতেই ধুয়ো ধরেন দলের বাকি সদস্যরা। শীতের সন্ধ্যায় গান যত এগিয়ে চলে মেঠো শ্রোতাদের ভিড়টা যেন আরও জমাট হয়। গানের শেষ চরণে এসে উদাত্ত গলায় গায়েন ফের গেয়ে ওঠেন-- ‘প্রীতিলতা মাতঙ্গিনী এই বঙ্গের মেয়ে/ সেই বঙ্গে ইজ্জত দিল কামদুনির মেয়ে/ দিল মধ্যমগ্রামের মেয়ে/ তাইতো বলি বঙ্গনারী আসুন সবে ধেয়ে/ খেলা যেন আর না হয় নারী শরীর নিয়ে/ খেলা যেন আর না হয় মায়ের ইজ্জত নিয়ে।’ সকলে গেয়ে ওঠেন হোল বোল হোল বোল। বেজে ওঠে খোল, করতাল। গলা মেলান দর্শক, শ্রোতা সকলেই।
নদিয়ার নিজস্ব ঘরানার এ লোকগানের নাম হোলুই গান। কেউ কেউ গানের শেষ চরণ অনুসারে এই গানকে ‘হোল বোল’ বলে থাকেন। কৃষ্ণকথা দিয়ে শুরু হলেও গানের আসল আকর্ষণ কিন্তু সমকালে ঘটে চলা নানা অন্যায়, অবিচারের কথা। তাই কামদুনি, মধ্যমগ্রামের ঘটনায় যখন সারা দেশ তোলপাড় তখন হোলুই গানে অকপটে সেই সব কথা তুলে ধরেছেন গায়েনরা। প্রতি বছর পৌষ মাস জুড়ে সারা গ্রামে গান গেয়ে তাঁরা সংগ্রহ করেন চাল, ডাল।
কৃষ্ণগঞ্জে হোলুই শিল্পীরা।—নিজস্ব চিত্র।
পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন, পয়লা মাঘ গ্রামের বাইরে কোনও মাঠে গিয়ে সেই চাল ডাল দিয়ে হয় বনভোজন। নদিয়ার স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক বুদ্ধিশ্বর ঘোষ বলেন, “মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে প্রচলন হয়েছিল হোলুই গানের। তারপর ধীরে ধীরে গানের ভাবের বদল হয়। সমকালীন নানা বিষয়ের কথা নিয়ে গান বাঁধা হতে থাকে। গ্রাম্য বধূর রোজনামচা থেকে পণপ্রথার মতো বিষয় একশো বছর আগের বাঁধা গানেও পাওয়া গিয়েছে। এই গানের ভূমিকা হল সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা জোগানো।”
হোলুই শিল্পীরা বলছেন, “গানে আমরা সোজা কথাটা সোজা করেই বলি। আর সেই কারণেই আমাদের পূর্ব পুরুষদের রাজা বা জমিদাররা পছন্দ করতেন না। এখন আমরাও ব্রাত্য।” সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের সময় ওঁরা গান বেঁধেছিলেন-- ‘জমি নিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে এখন করি কী/ চাষআবাদ বন্ধ হলে আমরা খাবো কী/ নগদ কড়ি ক্ষণস্থায়ী এই আছে, এই নেই/ সিঙ্গুরের জমি দেওয়ার পক্ষে আমরা নেই।’ সেবারের পৌষেও ওঁরা ডাক দিয়েছিলেন, ‘ও কিষাণ, ধর নিড়ানি, মাঠের পানে চল/ মাঠ আমাদের রুজিরুটি মাঠ আমাদের বল।”
হোলুই শিল্পী শ্রীমন ঘোষ, বসুদেব ঘোষ, নারায়ণ ঘোষরা বলছেন, “বুঝতেই পারছেন, এ গান শুনে তখনকার শাসক দল খুশি হয়নি। খুশি হচ্ছে না এখনকার শাসকরাও। কিন্তু কী করব বলুন কাউকে খুশি করার জন্য তো আমরা গান বাঁধি না।” বছর পনেরোর কেষ্ট ঘোষ হারমোনিয়ামকে কাছে টেনে নিয়ে বাবার মতো সেও গেয়ে ওঠে, “তাইতো বলি বঙ্গনারী আসুন সবে ধেয়ে/ খেলা যেন আর না হয় নারী শরীর নিয়ে...।”
ওঁদের অনেক কিছুই নেই। মেলাখেলায় ডাক নেই। লোকশিল্পীর প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও মেলেনি। তবে গান কেন? উত্তরটা দিলেন বসুদেব ঘোষ, “পরম্পরা কর্তা, পরম্পরা। আমাদের ছেলেরাও ভালবেসে গান গাইতে আসছে। এটাই কি কম প্রাপ্তি? তাই গান ছাড়তে পারব না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.