এখন ৭টা, আর করার কিছু নেই
কাল সাতটায় আচমকা নামতে শুরু করল পাল্স রেট। তখনই জানা হয়ে গিয়েছিল, বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ছাব্বিশ দিনের লড়াই শেষ হতে চলেছে।
আটটায় বন্ধ হল হৃদ্স্পন্দন। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। শুরু হল হার্ট ম্যাসাজ। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল শুক্রবার সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে।
টানাপোড়েন চলছিল বৃহস্পতিবার রাত থেকেই। প্রবল শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছিলেন। নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটরও কাজ দেয়নি। চিকিৎসা নিতে তাঁর প্রবল অনীহা যে বড় বিপদ ডেকে আনছে, ডাক্তারেরা সেই আঁচ পাচ্ছিলেন। কিন্তু সুচিত্রা চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করার জেদে এতটাই অনড় ছিলেন যে, ডাক্তারদের ভূমিকা হয়ে পড়ে কার্যত অসহায় দর্শকের।
এ দিন সকালে খবর পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছে যান। তত ক্ষণে ওখানে পৌঁছে গিয়েছেন সুচিত্রার মেয়ে মুনমুন ও দুই নাতনি রিয়া, রাইমা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালের বাইরে এসে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই মহানায়িকার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন। মমতা বলেন, সকালে ওঁর (সুচিত্রা সেনের) কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যায়।
শেষ নমস্কার, শ্রীচরণেষু মাকে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে মুনমুন সেন।
৮টা ২৫ মিনিটে মৃত্যু হয়। এ দিনই যে কেওড়াতলা শ্মশানে সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে, হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়েই তা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর পরেই হাসপাতালের সামনে ভিড় জমতে থাকে। আসতে থাকেন রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রী। বেলুড় মঠ থেকে হাসপাতালে এসে পৌঁছন তিন সন্ন্যাসী স্বামী বিমলাত্মানন্দ (তাপস মহারাজ), স্বামী সুদেবানন্দ (মাখন মহারাজ) ও স্বামী গুরুদশানন্দ (উজ্জ্বল মহারাজ)। সুচিত্রার মরদেহের গলায় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। পরানোর জন্য মুনমুনের হাতে সারদাদেবীর প্রসাদী শাড়ি তুলে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা রহমানও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এরই মধ্যে এসে পৌঁছয় শববাহী গাড়ি। তত ক্ষণে মহানায়িকাকে শেষযাত্রার পোশাক পরানো সারা। সাদা বেনারসি। তার উপরে সোনালি গরদের চাদর জড়ানো। মাথায় ঘোমটা, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। যেন শান্তিতে ঘুমিয়ে। কফিনে বন্ধ মরদেহ ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে তোলা হল বেলা সাড়ে বারোটায়। বালিগঞ্জের বাড়িতে মিনিট পাঁচেকের জন্য দেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সোজা কেওড়াতলা। গান স্যালুট দিয়ে মহানায়িকাকে শেষ সম্মান জানানো হয়। সুচিত্রার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী চন্দনকাঠের চিতায় দাহ করা হয় তাঁকে।
প্রশাসন-সূত্রের খবর: দিন কয়েক আগে সুচিত্রার সঙ্কট বাড়তে থাকায় তখনই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে শেষকৃত্যের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল সরকার। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর আসন্ন দার্জিলিং সফরকালে ঘটনাটি ঘটলে সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে কী করে সারা হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়। এমনও ভাবা হয় যে, মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিংয়ে থাকলে গণ-উন্মাদনা সামাল দিতে সমস্যা হতে পারে!
অতএব তখন কিছু ঘটলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই মহানায়িকার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করা হবে। এ দিন অবশ্য শেষকৃত্যের সব আয়োজন মসৃণ ভাবেই হয়েছে।
শোকার্ত দুই নাতনির পাশে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।
মেয়রের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জোগাড় হয় ৫০ কেজি চন্দনকাঠ ও বিপুল পরিমাণে গাওয়া ঘি। পুরোহিত বালানন্দ শাস্ত্রীকে পাঠিয়ে সাহায্য করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শ্মশানের কাগজপত্রে সই করেন সুচিত্রার জামাই ভরত দেববর্মণ। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে মুখাগ্নি হয় মুনমুনের হাতে। তার আগে মুনমুন এবং রাইমা-রিয়া মিলে মরদেহে ঘি মাখিয়ে আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। ঠিক চার ঘণ্টা বাদে মুনমুন মায়ের চিতাভস্ম নিয়ে বাবুঘাটে রওনা হন। হাসপাতালে সুচিত্রাকে সারিয়ে তোলার যুদ্ধে সেনানী ছিলেন যাঁরা, সুব্রত মৈত্র-সহ চিকিৎসকেরাও শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন। সুব্রতবাবুকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শববাহী গাড়ির পিছু-পিছু শ্মশানে যান। মমতা ও তাঁর মন্ত্রিসভার নবীন-প্রবীণ সদস্যদের অনেকেও আগাগোড়া হাজির ছিলেন।
জীবনের শেষ তিন দশক লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও সুচিত্রা সেনের আকর্ষণ যে প্রজন্মের সীমারেখার তোয়াক্কা করে না, এ শ্মশানের আবহই তার প্রমাণ। শ্মশানের বাইরে বা হাসপাতালে ভিড় করা ভক্তেরা ছাড়াও দেব, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, সোহমদের মতো টালিগঞ্জের তরুণ নায়ক-পরিচালকদের অনেকেই মহানায়িকার অন্তিম যাত্রার সাক্ষী হতে এসেছিলেন। তবে সুচিত্রার সমসাময়িকদের মধ্যে বিশ্বজিৎ ছাড়া কাউকে সে ভাবে দেখা যায়নি। টালিগঞ্জের প্রবীণদের কেউ কেউ অবশ্য জনান্তিকে জানিয়েছেন, সুচিত্রার নিভৃত জীবনযাপনের ইচ্ছেটুকুর মর্যাদা দিতেই তাঁরা সামনে আসতে চাননি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অগ্রজদের মধ্যে ছিলেন মিঠুন, প্রসেনজিৎ, দেবশ্রী প্রমুখ। বিকেলের দিকে শ্মশানে ঢুকে মিঠুন নিজে চিতায় কয়েকটি চন্দনকাঠ এগিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শোকের মধ্যেও বিশিষ্ট শ্মশানবন্ধুদের সুভদ্র সম্ভাষণে তৎপর ছিলেন মুনমুন, রিয়া, রাইমারা।
কী হতে চলেছে, কয়েক দিন আগে থেকেই তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। স্বভাবতই সুচিত্রার সুহৃদদের মানসিক প্রস্তুতিও কিছুটা গড়ে উঠেছিল। সব শেষের পরে মুহূর্তের জন্য তবু আবেগ ছলকে উঠল। হাসপাতাল থেকে বেরনোর আগে হঠাৎ স্বগতোক্তির ঢঙে মুনমুন বলে উঠলেন, ‘সো, এভরিথিং ইজ ওকে!’ পরে চিকিৎসকদের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক উচ্চারণ, “থ্যাঙ্ক ইউ!”
এত বছর প্রায় অসূর্যম্পশ্যা, অন্তরালবর্তিনী সুচিত্রা সেনের পথ চলা শেষ হওয়ার মুহূর্তটি যেন তখনই বড্ড বাস্তব, অমোঘ।

ছবি: রণজিৎ নন্দী।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.