পড়ুয়ারা স্কুলে আসছে কম, শেখার মানেও ঘাটতি
রাজ্যে সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত হচ্ছে। কিন্তু পড়াশোনার মানে উন্নতি হচ্ছে না। স্কুলশিক্ষা নিয়ে সর্বভারতীয় একটি সমীক্ষায় সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের এই ছবিই উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, পড়ুয়াদের স্কুলে অনুপস্থিতির হার বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে কমছে সহজ অঙ্ক কষার ক্ষমতা।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘প্রথম’ ভারতের প্রতিটি রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বাৎসরিক সমীক্ষা করে ২০০৫ সাল থেকে। ১৪ বছরের নীচে শিশুরা কতটা লিখতে-পড়তে পারছে, কেমন অঙ্ক কষছে, সাধারণ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে তা দেখা হয় তাদের বাড়িতে বসে। সেই সঙ্গে স্কুলে গিয়ে দেখা হয়, কত ছাত্র এসেছে, শিক্ষকরা ক্লাসে রয়েছেন কিনা, নানা শ্রেণির ছাত্র একই ঘরে ঠেসাঠেসি করে বসে আছে কি না।
এ রাজ্যে গত কয়েক বছরে সমীক্ষা থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। আর উঠে আসছে কিছু প্রশ্ন।
এক, স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু স্কুলের দিন ক্লাসে আসায় ফাঁকি বাড়ছে। এ বছরের হিসেব, রাজ্যের মোট শিশুর ৯৭ শতাংশেরই নাম লেখানো আছে স্কুলে। যা ইতিহাসে সর্বাধিক। যে শিশুদের স্কুলছুট হওয়ার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি, সেই ১১-১৪ বছরের মেয়েরাও এখন স্কুলছুট হচ্ছে কম। কিন্তু পড়ুয়ারা ক্লাসেও আসছে আগের চাইতে কম। পাঁচ বছর আগে হঠাৎ ক্লাসে গিয়ে দেখা গিয়েছিল প্রায় ৬৬ শতাংশ পড়ুয়াকে। এ বছর ৫৯ শতাংশকেও দেখা যায়নি। এ বিষয়ে এ রাজ্য বেশ কিছুটা পিছিয়ে দেশের গড়ের চাইতে (৭০.৭ শতাংশ)। অথচ আগের চাইতে বেশি স্কুলে মিড ডে মিল চালু হয়েছে, শৌচাগার, পানীয় জলের ব্যবস্থাও হয়েছে অনেক বেশি স্কুলে। তা সত্ত্বেও শিশুরা স্কুলে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে কেন?
দুই, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত পাঁচ বছরে অনেক ভাল হয়েছে। তা হলে ছাত্রদের ভাষা বা অঙ্কে দক্ষতা বাড়ছে না কেন? বরং দেখা যাচ্ছে, সাধারণ অঙ্ক করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে বেশি ছাত্র। এ বছর সহজ বিয়োগ (৫১-৩৫=?) করতে পারেনি দ্বিতীয় শ্রেণির অর্ধেকেরও বেশি ছাত্র, সহজ ভাগ (৭৬৯ কে ৬ দিয়ে) করতে পারেনি পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশেরও বেশি ছাত্র। দুটো সংখ্যাই প্রতি বছর বেড়ে চলেছে।
শিশু বা তার পরিবারের পড়াশোনায় আগ্রহ কম বলে এমন হচ্ছে, তা-ও ধরা চলে না। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ শিশুকে প্রাইভেট টিউশনে পাঠাচ্ছে পরিবার। ক্লাস ওয়ানেই অর্ধেকেরও বেশি খুদে পড়ুয়া যাচ্ছে টিউশন নিতে। তাতে কাজও হচ্ছে। সরকারি স্কুলের যে শিশুরা টিউশন নেয়, বাংলা পড়ায় তারা অনেকটাই এগিয়ে কেবল স্কুল-নির্ভর শিশুদের থেকে।
এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, এ রাজ্যের স্কুলে যা পড়ানো হচ্ছে, যেভাবে পড়ানো হচ্ছে, তাতে অধিকাংশ শিশু শিখছে অতি সামান্য। তাদের গোড়ার দক্ষতাগুলো তৈরি হচ্ছে না। চার-পাঁচ বছর স্কুলে যাওয়ার পরেও তারা সহজ বাংলা পড়তে পারছে না, সহজ অঙ্ক কষতে পারছে না।
এর একটা কারণ হতে পারে শিক্ষকদের একটি বড় অংশের পড়ানোয় অনাগ্রহ। গত কয়েক বছর ধরে এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৫ শতাংশের মতো শিক্ষক ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছেন। যারা আসছেন, তারাই বা কী করছেন? পাঠদানকে শিশুর জন্য আরও উপযোগী করতে শিক্ষকদের নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু ক্লাসে তার প্রয়োগ হয় না। আইআইএম কলকাতার অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “১৯৯৮ এবং ২০১১ সালে আমাদের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শিক্ষক-প্রশিক্ষণের প্রতিফলন ক্লাসে কার্যত নেই।”
অন্য একটি কারণের উপর জোর দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষা দফতর মনে করে, শিক্ষকদের মূল কাজ পাঠক্রম শেষ করা। ক্লাসের সব ছাত্র পড়তে-লিখতে-অঙ্ক কষতে পারছে, সেটা নিশ্চিত না করেই তাঁরা পাঠ্যবই শেষ করেন। অনেকগুলি রাজ্যে পরীক্ষামূলক গবেষণার ভিত্তিতে তাঁর সিদ্ধান্ত, “দক্ষতা অনুসারে ছাত্রদের দল তৈরি করে পড়ালে তারা অনেক দ্রুত পড়তে-লিখতে শিখছে।” অনেক রাজ্যে তাই স্কুলগুলিতে ‘সামার ক্যাম্প’ করে ছাত্রদের স্তর-অনুসারে শেখানো হচ্ছে।
প্রতীচী ট্রাস্টের কুমার রাণা মনে করেন, শিক্ষাদানের বিষয়ে পরিকল্পনার অভাব উদ্যোগী শিক্ষকদেরও বিপন্ন করছে। “প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের কী ভাবে পড়াশোনার মূলস্রোতে নিয়ে আসা যায়, তার পরিকল্পনা দরকার ছিল। শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় বিকেন্দ্রীকরণ করা হল না, শিক্ষকদের যে সহায়তার দরকার ছিল, তা-ও হয়নি। আমরা দেখছি, বহু শিক্ষক নিজেদের মতো করে পড়ানোর রীতিতে নানা উদ্ভাবন করে চলেছেন, কিন্তু শিক্ষার নীতিতে কিছুই স্বীকৃতি পায় না।” আমলাতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই শিশুরা আগ্রহ হারাচ্ছে, মনে করেন তিনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.