ঘনিষ্ঠমহলে মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই আক্ষেপ করেন, এ রাজ্যের খুব কম ছেলেমেয়েই আইএএস-আইপিএসের চাকরি পাচ্ছেন। অন্যরা যদি পারে, তা হলে আমরা কেন পারি না? সেই খেদ মেটাতেই এ বার পুরোদস্তুর সরকারি উদ্যোগে প্রশাসনিক চাকরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হচ্ছে রাজ্যে। সব ঠিক থাকলে, আগামী ২৫ জানুয়ারি তার উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নবান্ন সূত্রের খবর, সল্টলেকের প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ ভবনে (এটিআই) চলতি মাসেই ওই কোর্স চালু করে দেবে সরকার। তার জন্য কোর্স ফি দিতে হবে ১০০০ টাকা। তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ছেলেমেয়েদের জন্য কোর্স ফি অর্ধেক। অবশ্য ফি দিলেই যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নাম লেখানো যাবে, তা নয়। ভর্তির পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। তবে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত, ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় পাশ করেছেন কিংবা তার প্রাক-যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় (প্রিলিমস) উত্তীর্ণ হয়েছেন, এমন ছাত্রছাত্রীরা ফি ছাড়াই ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নাম লেখাতে পারবেন। পরীক্ষাও দিতে হবে না তাঁদের। রাজ্যের কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন বলেন, “দিল্লির বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়। বহু ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ে সাফল্য পেয়েছে। তারই কয়েক জন শিক্ষকের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।”
বর্তমান প্রশাসনে চাকুরিরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত এ রাজ্যের একাধিক আইএএস-ও মানছেন, যত দিন যাচ্ছে, সর্বভারতীয় প্রশাসনিক পরীক্ষায় (ইউপিএসসি) পশ্চিমবঙ্গের অংশগ্রহণ কমছে। স্বভাবতই কমছে উত্তীর্ণের সংখ্যাও।
সরকারি তথ্যই বলছে, গত ১০ বছরে এ রাজ্যের ১০ জনও আইএএস কিংবা আইপিএসের চাকরি পাননি। অথচ, শিক্ষকতা বা গবেষণার মতো অন্য সব ক্ষেত্রে ‘ঘরের ছেলেমেয়ে’দের কৃতিত্ব অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশি বই কম নয়। সচিব স্তরের এক অফিসারের আক্ষেপ, “বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকী সার্ন, নাসা-র মতো গবেষণা কেন্দ্রেও বাঙালি মিলবে। কিন্তু দেশের প্রশাসনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব দূরবীন দিয়ে দেখতে হয়।”
কেন এই হাল? কেনই বা প্রশাসনিক চাকরির প্রতি এত অনীহা বাঙালির? রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায় বলেন, “প্রশাসনিক চাকরিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেকে পছন্দ করে না। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজের মতো করে, অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে চাকরি করার প্রবণতা বাড়ছে।” পাশাপাশি, এ রাজ্যে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসার মতো প্রস্তুতি কেন্দ্র তৈরি না হওয়াটাও একটা প্রতিবন্ধকতা বলে মত প্রসাদবাবুর। আইএএস এবং আইপিএস তৈরিতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, তা মানছেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব অশোকমোহন চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, “এ রাজ্যে দীর্ঘদিন ভাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল না। এটা যেমন একটা কারণ, তেমনই অনেক ছেলেমেয়ে মেধার জোরে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পেলেও সর্বভারতীয় পরীক্ষার যে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি লাগে, সেটা সম্পূর্ণ করতে পারে না।”
উত্তরপ্রদেশে সেই প্রস্তুতিই অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। বেশ ক’বছর আগে তারা এমন ভাবে পাঠ্যসূচি তৈরি করেছে যার সঙ্গে সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলির সিলেবাসের কমবেশি মিল রয়েছে। তাতে সাফল্যও মিলেছে। পরবর্তী কালে ওড়িশাও সেই পথ অনুসরণ করেছে। কিন্তু এ রাজ্যে তেমন কোনও চেষ্টা হয়নি কখনও। একই সঙ্গে বহু বছর স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার উপরে বিধিনিষেধ থাকায় কিছুটা হলেও তার প্রভাব পড়েছে এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষায়। অশোকমোহনবাবুর মতে, বহির্জগৎ দেখার ক্ষেত্রে ইংরেজি একটা গুরুত্বপূর্ণ জানলা। তাতে জোর না দেওয়ার ফলে রাজ্যের ছেলেমেয়েদের ক্ষতি হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।
তা হলে বিহার, ওড়িশা বা উত্তরপ্রদেশ কি ইংরেজিতে এতই দড় যে তারা পশ্চিমবঙ্গকে পিছনে ফেলেছে? আইএএসদের একাংশ বলছেন, এ ভাবে এক বাক্যে উত্তর খোঁজা সম্ভব নয়। সাফল্যের একাধিক কারণ রয়েছে। ওই অফিসারদের মতে, এই সব রাজ্যে ছাত্রছাত্রীদের প্রশাসনিক চাকরির সুযোগ-সুবিধাগুলি কার্যত কলেজ জীবনের শুরুতেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষক ও বাড়ির লোকজনই মূলত সেই কাজটা করেন। এই তাগিদই পরবর্তী কালে ছেলেমেয়েদের সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় বলে মত ওই আইএএসদের। নবান্নের এক কর্তা বলেন, “গোবলয়ের বহু এলাকায় এখনও সামন্ততান্ত্রিকতার রেশ রয়ে গিয়েছে। প্রশাসনিক চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সেই মানসিকতাও অন্যতম কারণ।”
আদতে বিহারের সমস্তিপুরের বাসিন্দা, এ রাজ্যে সচিব স্তরের এক অফিসারের ব্যাখ্যা অবশ্য ভিন্ন। তাঁর বক্তব্য, “বিহারে তেমন ভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি কাজের পরিধিও।” এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক চাকরি ছাড়া অন্য রাস্তা খোলা নেই বলেই মত ওই আইএএসের।
পশ্চিমবঙ্গের আগে অবশ্য তামিলনাড়ু, গুজরাত ও মহারাষ্ট্র সরকার এমন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিল। আইএএসদের একাংশ বলছেন, দেরিতে হলেও এতে রাজ্যেরই লাভ হবে।
তবে সরকারি উদ্যোগে এমন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ যে এ রাজ্যে এই প্রথম, তা নয়। সরকারি সূত্র বলছে, বাম আমলের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজে এমন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিল রাজ্যের যুব দফতর। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন মুখ্যসচিব অমিতকিরণ দেব বলেন, “মূলত শিক্ষকের অভাবেই বেশি দিন সেটি চালানো সম্ভব হয়নি।”
বর্তমানে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর ও অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের উদ্যোগে দু’টি প্রশিক্ষণ চললেও তাদের ফল বলার মতো খুব একটা কিছু নয়। |