বীরভূমের রুক্ষ খোয়াইয়ের মাটিতে বিশ্বভারতীর শুরু হয়েছিল। সৃষ্টিশীল ও গুণী মানুষের সমাগমে এখানে এক সময়ে সমুদ্রের ঢেউ খেলেছে। শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে নানান মৌলিক চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান হয়েছে এই আশ্রমে। শিক্ষাসত্র ও পাঠভবনের পঠনপাঠনে তারই প্রকাশ ও ব্যাপ্তি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের জোয়ার কমেছে, ভাটার টান বেড়েছে। অনেক বাঁধ পড়েছে। সমুদ্র ক্রমশ পুষ্করিণীর আকার ধারণ করেছে। কেন এমনটি হল?
‘বিশেষত্ব ও বিশ্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘মানুষের এক প্রান্তে তার বিশ্ব, অন্য প্রান্তে তার বিশেষত্ব। এই দুই নিয়ে তবে তার সম্পূর্ণতা, তার আনন্দ।’ রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথা লিখেছিলেন, তার তুলনায় বিশ্ব বদলে গেছে অনেক। এবং বদলাচ্ছে ভয়ানক গতিতে। এই সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নের সঙ্গে যুদ্ধে আমরা হার মানছি। বিশ্বের চাপে বিশেষত্ব ধরাশায়ী। বিশ্বভারতী নানা ভাবে নিজের বিশেষত্ব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে তার নিজস্বতা ও আত্মবিশ্বাস।
এই ব্যাধির লক্ষণ প্রকাশ পায় নানান ভাবে। এখন আমরা একাগ্র চিত্তে আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের নকল করতে ব্যস্ত। মহানন্দে গড্ডলিকাপ্রবাহে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা চালু করেছি এমন সব বিষয়ের ডিগ্রি, যার সঙ্গে এই আশ্রমের কোনও যোগাযোগ নেই, প্রয়োজনও নেই। আর যে-সব ছাত্রছাত্রীর সেই সব ডিগ্রি প্রয়োজন, তাদের জন্য তো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে অজস্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এক দুশ্চিন্তার বিষয়, শিক্ষাক্ষেত্রে বিচিত্র জাতিভেদের সৃষ্টি। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি পায় ব্রাহ্মণের মর্যাদা। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের স্থান সবার নীচে, সবার পিছে, সর্বহারাদের মাঝে। |
বিশ্বভারতীর শিক্ষাব্যবস্থায় কখনওই এই আপত্তিকর জাতিভেদের স্থান ছিল না। রামধনুর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে সব রঙের সহাবস্থান। সব রং মিলেমিশে তৈরি হল আলো। এই আশ্রমেও সব বিষয় মিলেমিশে শিশুদের মন আলোকিত করে। এই শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই। আমি নিউরোসায়েন্স বা মস্তিষ্কবিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামাই, আর এই গবেষণার ভিতর দিয়ে নতুন করে বুঝতে পারছি যে, এই আশ্রমের শিক্ষা ও জীবনদর্শন কতটাই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও আধুনিক। শৈশব থেকেই এখানকার ছাত্রছাত্রীরা নিমগ্ন থাকে প্রকৃতির মধ্যে। লেখাপড়া, খেলাধুলা, গানবাজনা, ছবি আঁকা, সভা, উৎসব দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুর সঙ্গে এখানে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি। পরিবেশের সঙ্গে একই সুরে বাঁধা ছাত্রছাত্রীদের জীবন। তার মানে, শিশুর পঞ্চ ইন্দ্রিয় প্রতি মুহূর্তে পরিবেশের দ্বারা উদ্দীপিত হচ্ছে। আর শৈশবেই মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে সতেজ, সজাগ, নমনীয়। ভাস্করের হাতে নরম মাটি যেমন নানান আকার ধারণ করে, তেমনই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নানান নতুন অভিজ্ঞতা পারে শৈশবের মস্তিষ্ককে গড়ে তুলতে।
ঠিক কী ভাবে হয় এই গড়ার কাজটা? নানান অভিজ্ঞতা থেকে মস্তিষ্কের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ বৈদ্যুতিক সংকেত। আর এই বৈদ্যুতিক বার্তাগুলি গিয়ে সাড়া জাগাচ্ছে মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুকোষ অথবা নিউরন-এর ভিতর। কেমন দেখতে এই স্নায়ুকোষগুলি? শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জের গাছপালার মতোই তাদের চেহারা। তাদেরও আছে শাখাপ্রশাখা। আর, ডালপালার উপর যেমন ছড়িয়ে থাকে শতসহস্র সবুজ পাতা, নিউরনের শাখাপ্রশাখার উপর তেমনই বিরাজমান অজস্র ‘সিন্যাপ্স’। সিন্যাপ্স হল স্নায়ুর সংযোগস্থল। এই সংযোগস্থলেই একটি স্নায়ু থেকে আর একটিতে তথ্যের আদানপ্রদান হয়। সূর্যের আলো যে ভাবে ঠিকরে পড়ে গাছের পাতায়, তেমন করেই বৈদ্যুতিন বার্তা পৌঁছয় সিন্যাপ্স-এ।
শিশুমন যে এত কিছু শিখছে, দেখছে, শুনছে, এই সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার ছাপ গিয়ে জমা পড়ছে ওই সিন্যাপ্স-এ। সিন্যাপ্সগুলোর তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষমতা এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নানান অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সিন্যাপ্স-এর সংখ্যাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক কথায়, সমৃদ্ধ পরিবেশ মস্তিষ্কের ভিতরকার সমৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। যথেষ্ট আলো-বাতাস ও জল পেলে যেমন গাছের শাখাপ্রশাখা বেড়ে ওঠে, জন্ম নেয় নতুন পাতা; ঠিক তেমনটি হয় স্নায়ুকোষের ক্ষেত্রেও। সব মিলে বৃদ্ধি হচ্ছে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি, সৃষ্টিশীলতা, কল্পনাশক্তি। একেই বোধহয় আমরা বলি উর্বর মস্তিষ্ক।
সবচেয়ে দরকারি কথা হল, এই উর্বর জমিতে যে বীজই বপন করা হোক না কেন, তার বেড়ে ওঠার ক্ষমতা, তার ভিত এখন পাকা। এ ভাবেই অভিজ্ঞতার বৈচিত্র থেকে ঘটে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। সৃষ্টি হয় ভবিষ্যতে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির আকাশচুম্বী সম্ভাবনা। আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞান বলছে যে, নানান অভিজ্ঞতা থেকে যে-সব স্মৃতি জমা পড়ছে শিশুর মনে, তার সঙ্গে শুধু অতীত জড়িয়ে নেই, বরং তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের প্রস্তুতির চাবিকাঠি।
অতএব, বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে বলতে পারি, পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারণেই বিশ্বভারতীর শিক্ষাসত্র-পাঠভবনের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাব্যবস্থা এত কার্যকর, এমন বিশিষ্ট। অভিজ্ঞতার বৈচিত্র যত বেশি হবে, শিশুমনে ততই বেশি কৌতূহল ও বিস্ময় জাগবে। তার থেকেই মনের মধ্যে উঠবে নানান মৌলিক প্রশ্ন, শুরু হবে তর্কবিতর্ক। সেই সব প্রশ্ন থেকেই বীজ বপনের শুরু। কেউ জানতে চাইবে: কেমন করে অথবা কেন এমনটি হল? সে হয়তো হবে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী। আর এক জন উদ্দীপিত হবে কবিতা লিখে বা ছবি এঁকে অভিজ্ঞতা বা অনুভূতির বর্ণনা দিতে। অর্থাৎ, এক বার যদি শিশুমনে অদম্য কৌতূহল বা বিস্ময় জাগানো যায়, তা হলে শিক্ষার একটা বড় উদ্দেশ্য সফল। বাকিটা, যাকে বলে, খুঁটিনাটির ব্যাপার। পাঠভবনের ও শিক্ষাসত্রের শিক্ষা ও জীবনাদর্শনের একটি বড় লক্ষ্য ছিল এটাই।
শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিন্তাধারার সূত্রপাত তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে। ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের শুরুর দিকে এই সব অভিজ্ঞতার মজার বর্ণনা পাওয়া যায়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘‘যিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন, তিনি আমার মোহ বিনাশ করিবার জন্য প্রবল চপেটাঘাত-সহ এই সারগর্ভ কথাটি বলিয়াছিলেন ‘এখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছি, না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে।’ এত বড় অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী জীবনে আর কোনোদিন কর্ণগোচর হয়নি।’’ আবার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে লিখেছেন: “সেখানে কী শিক্ষালাভ করিলাম মনে নাই কিন্তু একটা শাসনপ্রণালীর কথা মনে আছে। পড়া বলিতে না পারিলে ছেলেকে বেঞ্চে দাঁড় করাইয়া তাহার দুই প্রসারিত হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি স্লেট একত্র করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইত। এরূপে ধারণাশক্তির অভ্যাস বাহির হইতে অন্তরে সঞ্চারিত হইতে পারে কি না তাহা মনস্তত্ত্ববিদদিগের আলোচ্য।”
এখন এই আলোচনায় আলোকপাত করতে পারে মস্তিষ্কবিজ্ঞান। প্রকৃতির সান্নিধ্যে মস্তিষ্কের ধারণাশক্তি কেমন করে জোরাল হয়, সে কথা বলেছি। ঠিক উল্টোটা হয় মানসিক ও শারীরিক চাপের কবলে পড়লে। স্নায়ুকোষের শাখাপ্রশাখা শুকিয়ে যায়, সিন্যাপ্স-এর ক্ষমতাও কমে যায়। একটানা চূড়ান্ত মানসিক চাপের ফলে সিন্যাপ্স-এর সংখ্যা যায় কমে, অর্থাৎ গাছের পাতা যায় ঝরে। এর ফলে ধারণাশক্তি কমে যায়, হারিয়ে যায় মানসিক ভারসাম্য। আজকের সমাজে এরই ফলে দেখা যাচ্ছে এত রাগ, দুঃখ, হতাশা।
রবীন্দ্রনাথের শৈশবের শিক্ষার অভিজ্ঞতা যে নতুন শিক্ষাচিন্তার জন্ম দেয়, তা থেকে ষোলো আনা লাভ হয়েছিল শিক্ষাসত্র ও পাঠভবনের সব ছাত্রছাত্রীর। তিনি ‘খাঁচার পাখি’ ছিলেন বলেই আমরা আজ বনের পাখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমরা চূড়ান্ত সৌভাগ্যবান। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে আমার শিক্ষার শুরু হয়েছিল আনন্দ পাঠশালায়। আমার প্রথম সাহিত্যসভার স্মৃতি তৃতীয় শ্রেণিতে। শ্যামলী বাড়ির সামনে পাক্কা দশটা মিনিট কোনও লেখা ছাড়াই ‘অ্যাপোলো টু’-এর বর্ণনা দিয়েছিলাম। সভার পরে বাহবা পেয়েছিলাম শ্রদ্ধেয়া নীলিমা সেন ও শ্রদ্ধেয় অমিয় সেন মহাশয়ের কাছ থেকে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আবৃত্তির ক্লাস নিতেন শম্ভু মিত্র মহাশয়, বাংলা পড়িয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন-এর ওয়ার্কশপ করলেন সতীশ গুজরাল। আর সেই ওয়ার্কশপ হল পদার্থবিদ্যা বিভাগে। এই ছিল আমাদের শিক্ষার চেহারা। এমন শিক্ষা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
আজ বৈজ্ঞানিকের চোখ দিয়ে সেই শিক্ষাব্যবস্থার মূল্য ও বিশেষত্ব নতুন করে বুঝতে পারছি। নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এই আশ্রম ও তার শিক্ষাদর্শের বিশেষত্ব তুলনাহীন। এই বিশেষত্বকে হারিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া শুধু নির্বুদ্ধিতাই নয়, মহাপাপও। বিশ্বের যা-কিছু ভাল, তা আমরা অবশ্যই নেব। সেই জন্যেই তো বিশ্বভারতী। কিন্তু তার জন্য নিজেদের বিশেষত্ব বিসর্জন দেব কেন? |
বেঙ্গালুরুতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এ মস্তিষ্কবিজ্ঞানের শিক্ষক |