সব মৃত্যু যে সমান নয়, তাহা বুঝিবার জন্য মাও জে দঙের পদ্য পাঠ করিবার প্রয়োজন নাই, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। দক্ষিণ কলিকাতার একটি বহুতল বিপণন কেন্দ্রে সম্প্রতি যে ‘দুর্ঘটনা’য় এক জন শ্রমিক নিহত এবং আরও কয়েক জন আহত হইয়াছেন, তাহার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অনৈতিকতা কতটা দায়ী, সেই বিষয়ে বৈপ্লবিক আলোড়ন তোলা যাইতে পারে। কিংবা, আলোড়ন দূরস্থান, ‘রাজনীতিসচেতন’ কলিকাতায় কেন সামান্য তরঙ্গও উঠিল না, সেই কৈফিয়ত তলব করিয়া গৌতম দেবাদি অগ্নিবর্ষী নায়কদের সর্বহারার আদালতে দাঁড় করানোও চলিতে পারে। কিন্তু তাহাতে মূল সমস্যা যেখানে আছে, সেখানেই থাকিয়া যাইবে। মূল সমস্যাটি ইহাই যে, স্বাভাবিক কিছু নিয়ম মানিয়া চলিবার মানসিকতা এই সমাজ এখনও আয়ত্ত করিতে পারে নাই। বিপণন কেন্দ্রটিতে শ্রমিকরা যে কাজ করিতেছিলেন, তাহার জন্য কিছু ন্যূনতম রক্ষাকবচ আবশ্যক। যথা মাথায় হেলমেট, কোমরে বেল্ট। এই রক্ষাকবচগুলি কোনও উচ্চ প্রযুক্তির দুর্লভ সামগ্রী নয়, ব্যয়বহুলও নয়। অথচ সেগুলি যথাযথ ভাবে ব্যবহৃত হইলেই এমন মর্মান্তিক পরিণতি কার্যত সুনিশ্চিত ভাবে এড়ানো যায়। এই মৃত্যু অ-সমান, কারণ ইহা সম্পূর্ণ ‘অ-প্রয়োজনীয়’। যাঁহারা এই ধরনের কাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তাঁহারা পরিকল্পিত ভাবে এই অতি সামান্য সরঞ্জামগুলি সরবরাহ করেন না, এমন কথা মনে করিবার কোনও কারণ নাই। স্পষ্টতই, ইহা ঔদাসীন্য। কিন্তু অমার্জনীয় ঔদাসীন্য। সে জন্য যথাযথ তদন্ত এবং বিচার অবশ্যই জরুরি।
কিন্তু যথেষ্ট নয়। যে বিচ্যুতির ফলে সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঘটিতে পারিয়াছে, তাহা কোনও ভাবেই ব্যতিক্রমী নয়। বরং এই ঔদাসীন্যই বঙ্গীয় সমাজের নিয়ম। খাস কলিকাতা শহরের রাজপথে যত্রতত্র এবং অহরহ এমন বিচ্যুতির অগণিত দৃষ্টান্ত প্রকট। ঔদাসীন্য কেবল অন্যের নিরাপত্তা বিষয়ে নয়, নিজের নিরাপত্তা বিষয়েও। বহু বাইক-আরোহী হেলমেট না পরিয়া যাতায়াত করেন, ততোধিক চালকের পিছনে হেলমেটহীন শিশু দিব্য বিরাজমান থাকে। ব্যস্ত রাজপথ এমনকী রেললাইন বরাবর চলিতে চলিতে বা গাড়ি চালাইতে চালাইতে কানের মোবাইল ফোনটিতে সমস্ত মনপ্রাণ ঢালিয়া দিবার দৃশ্যও অতি সুলভ। হয়তো ইহার মধ্যে এক ধরনের মজ্জাগত নিয়তিবাদের প্রভাব কাজ করে। যাহা হইবার তাহা হইবে ইহা যে সমাজের বীজমন্ত্র, সে চোখ মেলিয়া সম্পূর্ণ অরক্ষিত শ্রমিকদের বহুতল উচ্চতায় কাজ করিতে দেখিয়াও ভ্রুক্ষেপ করে না, উহাকেই স্বাভাবিক বলিয়া ধরিয়া লয়। এই সামাজিক ঔদাসীন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঔদাসীন্যের কোনও অজুহাত হইতে পারে না, কিন্তু নিরাপত্তার প্রয়োজন এবং তাহার বন্দোবস্ত সম্পর্কে সমাজ সচেতন ও তৎপর হইলে প্রতিকারের জন্য চাপ সৃষ্টিও তুলনায় সহজ হইতে পারে। সমাজ নিজে নিজে সচেতন বা তৎপর হইবে, এমন আশা নাই। এখানেই প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বিশেষ দায়িত্ব আছে। দুর্ঘটনা ঘটিবার পরে নয়, প্রতিনিয়ত এবং সর্বত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার গাফিলতি চিহ্নিত করা ও তাহার প্রতিকারের আয়োজন করা ও দাবি তোলাই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বর্তমান রাজ্য সরকার নানা বিষয়ে তৎপরতা দেখাইতেছে। সর্ব স্তরে নিরাপত্তার বোধ এবং তাগিদ জাগাইতে সচেষ্ট হইলে সরকারি কর্তা ও কর্ত্রীরা একটি বড় কাজ করিতে পারিবেন। |