অভ্যাস জিজ্ঞাসার পরম শত্রু। মানুষ যাহাতে অভ্যস্ত হয়, তাহার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিতে ভুলিয়া যায়। যাহা আছে, তাহাকেই বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে স্বাভাবিক, অমোঘ, এমনকী শাশ্বত বলিয়া ধরিয়া লয়। মানবাধিকার কমিশনের সহিত সহাবস্থানে নাগরিক সমাজ দীর্ঘ দিন অভ্যস্ত হইয়াছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সনদ ঘোষণা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং দেশে দেশে ও ক্রমশ নানা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বা প্রদেশে নিজস্ব মানবাধিকার কমিশনের সৃষ্টির মধ্য দিয়া এই ধারণা ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, মানবাধিকার রক্ষার জন্য এই প্রতিষ্ঠান থাকা আবশ্যক। অথচ, দেশের আইনে ব্যক্তির অধিকার যাহাতে সুরক্ষিত থাকে, অধিকার ভঙ্গ করিলে যাহাতে অপরাধীকে শাসনে আনা হয় এবং অপরাধ প্রমাণিত হইলে তাহাকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহার জন্যই শাসনতন্ত্রের বিশদ আয়োজন। আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ, এই তিনটি স্তম্ভের উপরে সেই তন্ত্র দাঁড়াইয়া আছে। সুতরাং এই প্রশ্ন আদৌ অযৌক্তিক নয় যে, ইহার পরেও কেন আবার মানবাধিকার কমিশনের প্রয়োজন? যে কারণে লোকপাল সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন ওঠে, সেই কারণেই মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কেও মৌলিক প্রশ্ন ওঠে। একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিবার অর্থ প্রতিষ্ঠানটিকে এক কথায় অপ্রয়োজনীয় বলিয়া সাব্যস্ত করা নয়। কিন্তু প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের প্রশ্নটি যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করা জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা প্রাসঙ্গিক। এ রাজ্যে মানবাধিকার কমিশনের ইতিহাস গৌরবময় নয়, বিবিধ আচার অনুষ্ঠান এবং বক্তৃতা ভিন্ন তাহাকে কাজের কাজ করিতে খুব একটা দেখা যায় নাই। অশোক গঙ্গোপাধ্যায় কমিশনের দায়িত্ব লইবার পরে সেই ইতিহাসে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসিয়াছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনায় তিনি তৎপর ও কার্যকর নজরদারের ভূমিকা পালন করিতেছিলেন, বিশেষত সরকারি প্রশাসন ও পুলিশের অন্যায়কে চিহ্নিত করিয়া প্রতিকারের জন্য নৈতিক চাপ সৃষ্টি করিতেছিলেন। বশংবদ মানবাধিকার কমিশনের ঐতিহ্য ভাঙিয়াছিলেন বলিয়াই সুযোগ বুঝিয়া তাঁহাকে পদত্যাগে ‘বাধ্য’ করা হইল কি না, সে প্রশ্ন অন্যত্র। কিন্তু এই ঘটনাপরম্পরা হইতে এমন সিদ্ধান্তের যথেষ্ট কারণ আছে যে, সরকার একটি অনুগত মানবাধিকার কমিশন চাহে। অতীত জমানাতেও চাহিয়াছে, বর্তমান জমানাতেও চাহিতেছে। এই মুহূর্তে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের একমাত্র সদস্য কিছু কাল আগে রাজ্য পুলিশের বড়কর্তা ছিলেন, এই ঘটনাটি সেই চাহিদা পূরণেরই উৎকট পরিণাম নয় কি?
যুক্তি মহাশূন্যে ভাসিয়া থাকিতে পারে না, তাহাকে বাস্তবের কঠিন ভূমিতে পথ কাটিয়া চলিতে হয়। একটি আদর্শ শাসনতন্ত্রে মানবাধিকার কমিশনের প্রয়োজন নাই এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিবার পরেও যুক্তিকে আদর্শের মহাশূন্য হইতে কঠিন বাস্তবে নামিতে হয়। সেই বাস্তব পৃথিবীতে শাসনতান্ত্রিকরা নাগরিকের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রায়শই অধিকার হরণে তৎপর। এই ব্যাধি কালজয়ী। দলজয়ীও। বামফ্রন্টের নেতারা অম্বিকেশ মহাপাত্র বা শিলাদিত্য চৌধুরীর দৃষ্টান্তগুলি লইয়া পঞ্চমুখ হইয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের জমানাতেও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী তথা মুখপাত্র কেবল প্রকাশ্য সভায় শাসনকর্তাদের মুখের উপর অপ্রিয় প্রশ্ন তুলিবার অপরাধে যে আক্রমণের শিকার হইয়াছিলেন, তাহা অবিস্মরণীয়। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে কোন ভাষায় এবং ভঙ্গিতে মানবাধিকারের প্রশ্নগুলিকে উড়াইয়া দিবার সাহস দিয়াছিলেন, তাহাও ভুলিবার কারণ নাই। ইহা ক্ষমতার ব্যাধি। মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান এই ব্যাধির প্রতিষেধক স্বরূপ। সেখানেই তাহার গণতান্ত্রিক গুরুত্ব। ব্যাধি নির্মূল হইলে ঔষধের আর প্রয়োজন থাকিবে না। কিন্তু ক্ষমতার ব্যাধি দুর্জয়। |