দশ মাসে তিন বার।
তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগ তুলে বারবার আন্দোলনে সামিল হয়েছেন দলেরই কাউন্সিলরেরা। অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন খোদ পুরপ্রধানের বিরুদ্ধেই। বৃহস্পতিবার দুপুরে দলের আট কাউন্সিলরের অনশনের জেরে ফের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল সিউড়ি পুরসভায়। যার পিছনে বিভিন্ন ঘটনায় বারবার প্রকাশ্যে চলে আসা দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বকেই দুষছেন জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
সিউড়ি পুরসভাকে ঘিরে এই ধরনের ঘটনায় বারবার বিড়ম্বনায় পড়ছেন খোদ পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। জেলা সদরের পুরবোর্ডকে ঘিরে এমন কর্মকাণ্ডে মুখ পুড়ছে তৃণমূলেরও। গোটা ঘটনায় এ দিন নিজের ক্ষোভ চেপে রাখেননি জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ‘বিক্ষুব্ধ’ কাউন্সিলরদের সঙ্গে দলের কোনও ‘সম্পর্ক’ নেই বলেও ঘোষণা করে দিয়েছেন। অন্য দিকে, বেকায়দায় পড়ে আন্দোলনকারী আট কাউন্সিলরের শাস্তির দাবি জানিয়ে দলীয় নেতৃত্বের কাছে দরবার করেছেন পুরপ্রধানও। এ সব সত্ত্বেও এতটুকুও দমছেন না আন্দোলনকারীরা। উল্টে উজ্জ্বলবাবুর প্রতি কটাক্ষ করে তাঁরা বলছেন, “আমরা বর্তমান পুরবোর্ডের সমস্ত খরচের হিসেব জনসমক্ষে তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছি। উজ্জ্বলবাবুর যদি সৎসাহস থাকে, তা হলে অবিলম্বে তিনি তা করে দেখান।” |
সিউড়ি পুরসভা চত্বরে অনশনে বসেছেন তৃণমূলের ৮ কাউন্সিলর।
|
এ দিন সকালে প্রায় হাজার দেড়শো সমর্থক নিয়ে ওই কাউন্সিলরেরা পুরসভায় চলে আসেন। বেলা ১২টা নাগাদ প্রশাসনিক ভবন থেকে তাঁরা পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শ্লোগান দিতে দিতে অনশন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান। একটি প্রচারপত্রও বিলি করেন। অনশনে বসে পড়েন দীপক দাস, পূর্ণিমা মাহারা, মহম্মদ শামিমা, প্রীতিকণা ভট্টাচার্য, অমিতা সাহা, তপন সুকুল এবং উত্তম দাস। পরে যোগ দেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইয়াসিন আখতার। মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল ছবি দেওয়া ব্যানারের সামনেই শুরু হয় অনশন কর্মসূচি। দীপকবাবুরা জানিয়েছেন, পুরুষ কাউন্সিলরেরা আমরণ অনশন করলেও মহিলারা রিলে পদ্ধতিতে অনশন করবেন। প্রচারপত্রে উজ্জ্বলবাবুর বিরুদ্ধে ফের সিউড়ির জলপ্রকল্প-সহ একাধিক ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। পাশাপাশি বাসিন্দাদের জন্য এগারো দফা পরিষেবার দাবিও জানানো হয়েছে। আন্দোলনকারীদের পক্ষে প্রাক্তন উপপুরপ্রধান তথা ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দীপক দাস বলেন, “আমরা দীর্ঘ দিন ধরে এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব কোনও সুরাহাই করছেন না। তাই বাধ্য হয়েই অনশনে বসা। এ বার এর শেষ দেখে ছাড়ব!” সিউড়িবাসীর উদ্দেশে লেখা ওই প্রচারপত্রে তাঁরা দাবি করেছেন, সিউড়ির বর্তমান পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় পুরসভার বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত। একই সঙ্গে তিনি পুরবাসীকে সঠিক পরিষেবা দিতেও ব্যর্থ। |
নানা অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ। |
গত পুর নির্বাচনের ১৮ আসনে সিউড়ি পুরসভায় তৃণমূল ৮, কংগ্রেস ৬, বামফ্রন্ট ৩ এবং নির্দল একটি আসনে জেতে। তৃণমূলের পুরপ্রধান প্রার্থী প্রীতিকণা ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের সমর্থনে ১০-৮ ব্যবধানে জিতে পুরপ্রধান হন উজ্জ্বলবাবু। কার্যত তখন থেকেই পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তৃণমূল কাউন্সিলরদের একাংশ। মাস পাঁচেকের মধ্যেই উজ্জ্বলবাবু দল পাল্টে ফেলায় বোর্ড চলে আসে তৃণমূলের হাতে। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, এর কিছু দিন পর থেকেই পুরসভার বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে উজ্জ্বলবাবুকে সতর্ক করা হয়। তৃণমূল পরিচালিত বোর্ডের পুরপ্রধান হওয়ার পরে মাসখানেকের মধ্যেই একটি বোর্ড মিটিংয়ে একটা বড় অংশের কাউন্সিলর পানীয় জল ও গৃহ নির্মাণের টাকা অন্য খাতে খরচ করা নিয়ে তাঁকে সতর্ক করেন। এর পরে ফের তাঁকে সতর্ক করা হয় পিএইচই-র ন’টি টিউবওয়েল বসানোর ক্ষেত্রে ৭ লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা খরচের বিষয় নিয়েও। তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধা ক্ষোভ বিরোধিতার আকার নিচ্ছিল বলে খবর। ক্ষুব্ধ দলীয় কাউন্সিলরেরা প্রশ্ন তোলেন, পিএইচই-র কল বসানোর খরচের টাকা জেলাশাসকের দফতর থেকে দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন তিনি পুরসভার খাত থেকে তার খরচ দেখিয়েছেন। বিদ্যুতের ভেপার ল্যাম্প ও সরঞ্জাম কেনা নিয়েও সরব হন তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ কাউন্সিলরেরা। উজ্জ্বলবাবু অবশ্য কোনও ক্ষেত্রেই কোনও অনিয়ম-বেনিয়ম হয়নি বলে দাবি করতে থাকেন। একের পর এক ঘটনায় একজোট হন ক্ষুব্ধ কাউন্সিলরেরা। গত ১৩ মার্চ পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবও তাঁরা আনেন। ভোটের ফল ছিল ৯-৯। দীপকবাবুরা এর পরে পুরপ্রধানের অপসারণের দাবি করলেও উজ্জ্বলবাবু তাতে কর্ণপাত করেননি। গত ১৪ ডিসেম্বর ফের সিউড়ির জলপ্রকল্পকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কাউন্সিলরেরা চিঠি দেন খোদ পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। চিঠিতে জলপ্রকল্পের উদ্বোধন না করার জন্যও আবেদন জানানো হয়। তৃণমূলের তরফে উদ্বোধক হিসেবে পুরমন্ত্রীর নাম থাকলেও বিতর্কের পরে তিনি আর সিউড়ি আসেননি।
তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, দলীয় পুরপ্রধান বনাম কাউন্সিলরদের এই লড়াই আসলে জেলা নেতৃত্বের দুই গোষ্ঠীর লড়াই। বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী উজ্জ্বলবাবুর বদলে দীপকবাবুকেই পুরপ্রধান বানাতে চায়। উজ্জ্বলবাবু অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। অন্য দিকে, দীপকবাবু সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপন ঘোষ-গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা। এ দিন উজ্জ্বলবাবুও বলেছেন, “দীপকবাবু আসলে পুরপ্রধান হতে চান। তাই প্রথম থেকেই নানা ভাবে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন।” উল্টো দিকে দীপকবাবু বলেন, “আমরা সিউড়িবাসীর কাছে দায়বদ্ধ। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি। এ ব্যাপারে জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকেও স্পষ্ট করে সমস্ত কিছু জানানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না।” সিউড়ি পুরসভাকে ঘিরে এই কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বপনবাবুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শুধু বলেন, “সিউড়ির জলপ্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব অবগত আছেন। তাই এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করব না।” এ দিকে, দলীয় কাউন্সিলরদের তোলা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে অনুব্রত অবশ্য উজ্জ্বলবাবুর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। এ দিন সন্ধ্যায় ফোনে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কথা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “ওই কাউন্সিলরদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্কই নেই। ওঁরা নাটক করে দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন। পুরসভার উন্নয়নের কাজেও বাধা দিচ্ছেন। দুর্নীতি যদি হয়ে থাকে, তা হলে তা দীপকবাবু যখন উপপুরপ্রধান এবং তপনবাবু যখন পুরপ্রধান ছিলেন, তখনই হয়েছে।”
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে দীপকবাবুদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়েছেন উজ্জ্বলবাবুও। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এ দিন ওই কাউন্সিলরেরা পুরসভার চত্বরে মাইক বাজিয়ে কাজে সমস্যা তৈরি করছেন। এ ভাবে বারবার উন্নয়নের কাজে বাধা দিচ্ছেন। এ জিনিস আমরা আর বেশিদিন বরদাস্ত করব না। দলের কাছে ওই কাউন্সিলরদের শাস্তির দাবি জানিয়েছি।” |
নিশানায় উজ্জ্বল |
• জলপ্রকল্প ও বস্তি উন্নয়নে কয়েক কোটি টাকার নয়ছয়।
• গাড়ি ভাড়া ও হোটেল খরচের লক্ষাধিক টাকার ভুয়ো টিএ বিল।
• অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে ভুয়ো বিল।
• পুরসভার ট্রাক্টরের ভুয়ো তেলের বিল।
• পুরসভার দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়ার টাকার ক্ষেত্রে দুর্নীতি।
• পিএইচই-র বসানো নলকূপের খরচ পুর-খাতে দেখানো।
(আন্দোলনকারীদের দাবি) |
|
ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |