প্রায় ঘরবন্দি হয়ে বৃষ্টিভেজা দুর্গাপুজো কাটানোর পরে লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনই বেরিয়ে পড়লাম সদববলে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আট জনে চললাম গুজরাট। আহমেদাবাদ পর্যন্ত ট্রেন। তারপর চার চাকার গাড়ির ভরসায় শুরু হল ১০ দিনের যাত্রা।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ভারতের বৃহত্তম লবণাক্ত বালিয়াড়ি কচ্ছের প্রধান শহর ভুজ। ভুজের নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের কথা। দু’বছরের মধ্যে অবশ্য ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ এবং আরও কিছু সংস্থার তত্পরতায় ভুজের পূর্বাবস্থা অনেকটাই ফিরে এসেছে। তবে এখনও প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে সেই ক্ষণটার কথা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। কিছু দোতলা বাড়ির গায়ের ফাটলও যেন স্মৃতি চিহ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে।
|
পৌঁছেই ভুজের মূল আকর্ষণ স্বামী নারায়ণ মন্দির, আয়না মহল ও মিউজিয়াম দেখলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কচ্ছের বৃহত্ রণ ভাল করে দেখা। তাই সে দিনটা ভুজে থেকে পরের দিন গেলাম ভারতের উত্তর পশ্চিমে আরব সাগরের তীরে, শেষ ভারতভূমি কোটেশ্বর শিব মন্দির, হিংলাজ মাতা ও নারায়ণ সরোবরে। ফিরতি পথে নালিয়া হয়ে মাণ্ডবী বিচ থেকে আরব সাগরের বুকে সূর্যাস্ত দেখলাম। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। এখানে সন্ধ্যেটা আমাদের চেনা সময়ের থেকে একটু পরেই নামে।
তৃতীয় দিন সকাল ৬টায় যখন শ্বেতশুভ্র রণ-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি তখন বেশ অন্ধকার। গুজরাটের চকচকে মসৃণ রাস্তায় ১০০ কিমি প্রতি ঘন্টা গতিতে গাড়ি করে পৌঁছলাম সাদা লবণে ভরা হোয়াইট রণে। ভুজ ছাড়িয়ে ১৮০ কিমি দূরে এ পথের দু’দিকে শুধুই বাবলা গাছ আর ধু ধু বিস্তৃত মরুভূমি। অন্যরকম সুন্দর। জনবিরল এই রণে বইয়ে দেখা গুর্জার পুরুষ এবং মহিলাদের পোশাকের বৈচিত্র্য দেখলাম। পুরো চত্বরের একমাত্র চায়ের দোকানে দোকানীর আতিথেয়তায় এবং ৫ টাকায় এক প্লেট চা খেয়ে মুগ্ধ হলাম। গোটা গুজরাটেই প্লেটে চা ঢেলে খাওয়ার চল রয়েছে। এ বার গন্তব্য ভারতের উত্তর পশ্চিম উপকূলের শেষ পার্বত্য এলাকা কালাডুংগার। এখান থেকে আবর সাগর পেরিয়ে দক্ষিণ পাকিস্তানের করাচি শহর মাত্র ৫০ কিলোমিটার। কালাডুংগারের উপর থেকে যতদূর চোখ যায় আরব সাগর এবং বৃহত্ রণের মনোহারী রূপ দেখলাম। এ বার ভুজে ফেরার পালা। |
এর পরের তিন-চার দিন আমরা জামনগর, দ্বারকার দ্বারকাধিশ মন্দির, ভেট দ্বারকতা, পোরবন্দর, মাধওপুরা সি বিচ, দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের একটি সোমনাথ মন্দির দেখলাম। সোমনাথ থেকে গির অরণ্যে সিংহ দর্শন সেরে পৌঁছলাম ভারতের পশ্চিমে আরব সাগরে ঘেরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিউয়ে। তখন দেওয়ালির প্রস্তুতি চলছিল। ফলে রাতের আঁধারে ছবির মতো দেওয়ালির আলোয় সেজে ওঠা দিউকে দেখতে পেলাম। পরের দিন গেলাম দিউ-এর সেরা আর্কষণ নয়ডা কেভে। অদ্ভুত সুন্দর এই প্রাকৃতিক গুহা ও কুকরি শিপ মেমোরিয়াল ঘুরে দেখলাম। বিকেল কাটালাম দিউ-এর নাগোয়া বিচে। এখানে তালগাছের মতো দেখতে স্থানীয় ‘ওকা তাড়’ নামের গাছ দেখলাম। কিন্ত অদ্ভুত ওই গাছগুলির একেকটির ৮টি বা ১৬ মাথা। আলোয় সাজানো ছিল গাছগুলি। সবমিলিয়ে র্সূযাস্তের পরে অপরূপ লাগছিল বিচটিকে।
পরের দিন দিউকে বিদায় জানিয়ে জৈনদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র পালিতনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পালিতানায় শত্রুঞ্জয় পাহাড়ে প্রায় ৮৬২টি মন্দির রয়েছে। যার অনেকগুলিই প্রাচীন। মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের কাজ নজরকাড়ার মতো। পালিতানা থেকে গেলাম লোথাল, হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে। এখানে এএসআই-এর মিউজিয়ামের প্রর্দশণী দেখতে দেখতে প্রাচীন যুগকে ফিরে দেখা যায়। পাশেই খননীকৃত জলাশয়, কুয়ো, স্নানঘর, কবরস্থানের ভগ্ন নিদর্শন দেখলাম। লোথাল থেকে আহমেদাবাদের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে ১০ দিনে প্রায় ২৮০০ কিমি পথ পরিক্রমা করে শেষ করলাম গুজরাট ভ্রমণ। |