চাষেই স্বাচ্ছন্দ্য, তিন কৃতীকে পুরস্কার
ধুনিক প্রযুক্তি এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশল—এই দুই জাদুতে কম খরচে লাভের মুখ দেখেছেন পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের তিন চাষি। এঁরা হলেন মায়াচরের দীপককুমার সানা, কাঞ্চনপুরের গুরুপদ করণ, রামবাগ গ্রামের শেখ জামালউদ্দিন। পলি হাউসে অসময়ের চাষ দীপকবাবুর তুরুপের তাস হলে গুরুপদবাবুর মিশ্র চাষ। আর বছর আটান্নর জামালউদ্দিন জোর দেন জৈব সারের প্রয়োগে। মহিষাদলে সদ্য শুরু হওয়া জেলা কৃষি মেলায় এই তিন জনকে পুরস্কৃত করছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি এদের চাষের কৌশল ‘মডেল’ করে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে চাষিদের দেখাবে কৃষি দফতর।
মায়াচরের বাসিন্দা বছর পঁয়তাল্লিশের দীপককুমার সানা জানান ‘পলি হাউস’ এবং ‘ফাঁদ ফসল’-ই সাফল্য এনে দিয়েছে তাঁকে। পলিথিনের চাঁদোয়ার নীচে জমি ঢাল রেখে অসময়ের নানা সব্জি যেমন বর্ষায় ফুলকপি, পালং শাক, নটেশাক, ধনেপাতা, বীন ইত্যাদি চাষ করেন তিনি। পাশাপাশি পোকামাকড়, ছত্রাক-ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে ফসলকে বাঁচাতে টোপ হিসাবে ব্যবহার করেন হলুদ গাঁদা, এবং হলুদকে। এটাই ফাঁদ ফসল। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু কীটপতঙ্গ গাঁদা পাতার তীব্র গন্ধ এড়িয়ে চলে আবার কিছু কীটপতঙ্গ গাঁদা ফুলের রং-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায়। আসুক আর যাক—যেটাই হোক না কেন—রক্ষা পায় পাশের সব্জি খেত। আর হলুদ গাছ মাটির তলায় ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। সব্জির পাশাপাশি এই দুই চাষ করলে তাই রোগের হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যায়। আবার হলুদ, গাঁদা বাজারে ভাল দামে বিক্রিও হয়ে যায়। এই ভাবেই আড়াই বিঘা জমি জৈব সার ও কীটনাশক দিয়ে সপরিবার চাষ করেছেন দীপকবাবু। আর চাষে লাভ নেই এই চলতি কথাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন বার-বার। দীপকবাবু বলেন, “চিরাচরিত প্রথায় চাষ করে খুব বেশি লাভ হত না। তখন কৃষি দফতরের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি।” তারপরই সাফল্য মেলে। তাঁর কথায়, “বাড়িতেই জৈব সার তৈরি করি। নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করাই। তবে পলি হাউস ও ফাঁদ ফসলের ভাবনাটাই আমাকে বাড়তি সাফল্য এনে দিয়েছে।”
শেখ জামালউদ্দিন। গুরুপদ করণ। দীপককুমার সানা।
—নিজস্ব চিত্র।
কাঞ্চনপুরের বাসিন্দা গুরুপদ করণের কৃতিত্ব আবার মিশ্র চাষে। এক ইঞ্চিও জমি ফেলে না রেখে ‘সাথী’ ফসল ফলান তিনি। নিজের হাতে তৈরি করেন জৈব কীটনাশক। গুরুপদবাবু সাড়ে সাত বিঘা জমিতে আমন চাষ, তিন বিঘাতে বোরো চাষ, আড়াই বিঘাতে শাঁকালু ও সাথী সফল হিসাবে শাকসব্জি চাষ করেন। তিনটি পুকুরে মাছ চাষ করেন। আছে কয়েক’টি গরুও। তিনি বলেন, “আমি এক ইঞ্চি জমিও নষ্ট করি না। বাদ দিই না পুকুর পাড়, বেড়াও। মিশ্র চাষ করেই আমি পাকাবাড়ি করেছি। সাড়ে চার বিঘা জমি কিনেছি। বাড়িতে নিজস্ব পদ্ধতিতে শাঁকালু সংরক্ষণ করে তা পরে চার গুণ দামে বিক্রি করি।”
বছর আটান্নর জামালউদ্দিন ধান চাষ করেন জৈব সার (কেঁচো সার)। ব্যবহার করেন আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত প্রজাতির বীজ। ছ’বিঘা জমিতে আমন ও বোরো চাষ করেন তিনি। সব্জি, মাছ গো-পালন তো রয়েছেই। তিনি বলেন, “আগে সাধারণ ভাবে চাষ করে কোনও রকমে সংসার চলত। গত পাঁচ বছর ধরে স্থানীয় সমবায় থেকে জৈব সার কিনে চাষ করছি। তাতে চাষের খরচ যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে ফলন।’’ তাঁর কথায়, “বিঘা প্রতি অন্তত তিন কুইন্টাল ফলন বেড়েছে। আমাকে দেখে অনেক চাষি ওই পথ নিয়েছেন। এটা আনন্দের।”
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কৃষি আধিকারিক তথা কৃষি বিশেষজ্ঞ মৃণালকান্তি বেরা বলেন, “ধান, সব্জি, উদ্যান পালন, মৎস্য কিংবা গোপালন সব ক্ষেত্রেই এঁরা যে ভাবে আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে ধারাবাহিক ভাবে সফল হয়েছেন তা সকলের শিক্ষণীয়।” কৃষি দফতরের তরফে রীতিমতো মাঠে গিয়ে সরেজমিন খতিয়ে দেখার পর ইন্টারভিউ নিয়ে ওই তিন জনকে বাছা হয়েছে। জেলা পরিষদের কৃষি ও সেচ কর্মাধ্যক্ষ বুদ্ধদেব ভৌমিক বলেন, “চাষবাস আর গবাদি পশু পালন করেও যে স্বাচ্ছন্দ্য আসতে পারে জীবনে, তার প্রমাণ এঁরা।”
শিল্পশহর হলদিয়ার পাশের ব্লক মহিষাদলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি, সাফল্য ও কৃষকদের মানসিকতার ইতিবাচক এই পরিবর্তন বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছে জেলা কৃষি দফতরের। তাই এ বার জেলা কৃষি মেলা হচ্ছে মহিষাদলে। বুধবারই শুরু হয়েছে এই মেলা। জেলার উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) প্রণবেশ বেরা বলেন, “জেলার কৃষিক্ষেত্রে মহিষাদলের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। তা বিচার করেই এ বার মহিষাদলকে জেলা কৃষি মেলা করার জন্য বেছে নিয়েছে জেলা প্রশাসন।”
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে হিজলি ট্রাইডাল ক্যানালের সংস্কার প্রকল্পের উদ্বোধনে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছিলেন, ৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হলে মহিষাদলে সবুজ বিপ্লব আসবে। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের পাশের এই ব্লককে কৃষিক্ষেত্রে এগিয়ে রাখবে ট্রাইডাল ক্যানাল। প্রকল্পের কাজ হওয়ায় সুফলও পাচ্ছেন কৃষকরা। আজ, বৃহস্পতিবার মহিষাদল রাজ ময়দানে জেলা কৃষি মেলার ওই তিন কৃতী কৃষককে সরকারি পুরস্কার তুলে দেবেন শুভেন্দু।
তিন চাষির সাফল্য অন্যদের কতটা প্রভাবিত করতে পারে, দেখার সেটাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.