|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
একে শিশু, তায় গরিব, কার কী যায় আসে |
এক দশকে খাবারদাবার, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। মিড ডে মিল-এর বরাদ্দ দেড়গুণও হয়নি।
যাঁদের ওপর রান্নার ভার, গ্রামের সেই গরিব ঘরের মেয়েদের প্রাপ্যও অকিঞ্চিৎকর। কারও মাথাব্যথা নেই।
পিয়ালী পাল ও কুমার রাণা |
বীরভূম জেলার একটি প্রাইমারি স্কুল। একদল শিশু স্কুলের বারান্দায় সারি দিয়ে বসে, সামনে ভাতের থালা। হাতা থেকে চলকে পড়ে পাতলা ডাল, সঙ্গে একটুখানি আলু-সয়াবিনের তরকারি। অন্য দিকে, ক্লাসরুমের ভিতর কয়েক জন নিজেদের টিফিন বাক্স থেকে বার করছে চিপস, পরোটা, বিস্কুট। সকলেই একই স্কুলে পড়ে, একই শিক্ষক, এক ক্লাসরুম, এক বই, একই বিষয়, কিন্তু তার মধ্যেই এই তথাকথিত সহপাঠীরা পেয়ে যাচ্ছে জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পাঠ। একদল খাচ্ছে স্কুলের মিড-ডে মিল, আর অন্য দলকে বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছে ‘পচা খাবার, খাস না’। তারা শিখছে: যারা মিড-ডে মিল খায়, তারা আলাদা, তারা মর্যাদায় নিকৃষ্ট। যেহেতু সরকারি স্কুল এবং এখানে মর্যাদা-নিকৃষ্টরাই সংখ্যাবহুল, সে কারণে মিড-ডে মিলের পঙ্ক্তিতেই সংখ্যাধিক্য। কিন্তু তা হলেও বিভাজনটা স্পষ্ট, সহপাঠীরা গোত্র-বিভক্ত।
কিন্তু, আবার ব্যতিক্রমও আছে। বীরভূম জেলারই অন্য এক স্কুলে দেখা গেল অন্য রকম ছবি। ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলমান, বাগদি-ব্রাহ্মণ নির্বিশেষে সব শিশুই একসঙ্গে মিড-ডে মিল খাচ্ছে। পার্থক্যের কারণ, এই স্কুলে খাবারের গুণমান বেশ ভাল। তা হলে প্রথম স্কুলটাতে মান খারাপ কেন? কেন ডাল পাতলা, তরকারি বিস্বাদ? তা হলে কি...? না, এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনও যোগ নেই। বেশির ভাগ স্কুলেই এখন মিড-ডে মিলের অবস্থাটা এই রকম, ব্যতিক্রমগুলো ব্যতিক্রমী কারণেই। সাধারণ অবস্থাটা ভাল না।
‘কী করে ভাল হবে? মাথাপিছু বরাদ্দ ৩ টাকা ৫১ পয়সা। এর মধ্যে ডাল, তেল, সব্জি, মশলা, কাঠ, ডিম, মাছ, মাংস— হয়?’ প্রশ্ন করলেন শিক্ষক। প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচিত। এটা শুধু মিড-ডে মিল পরিচালনার সমস্যাই নয়, সরকারি নীতির মস্ত একটা ভণ্ডামির দিকও মিড-ডে মিল বরাদ্দের অবস্থা থেকে উঠে আসে। |
|
একটু খোলসা করা যাক। গোড়া থেকে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ প্রয়োজনের চেয়ে কম বলে অভিযোগ ছিল। প্রকল্প চালু হওয়ার সময় ২০০৪ সালে মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ১ টাকা, যা ২০০৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১৩’য় এটা হয়েছে ৩ টাকা ৫১ পয়সা। অর্থাৎ, ২০০৭ থেকে ২০১৩-র মধ্যে টাকাটা বেড়েছে ৪০ শতাংশ। কিন্তু যে-সব জিনিস কেনার জন্য এই বরাদ্দ— চাল, ডাল, সব্জি, মশলা, জ্বালানি— সেগুলোর দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ, অর্থাৎ দ্বিগুণ!
শুধু অপ্রতুল ব্যয়বরাদ্দেই নয়, শিশুদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় শঠতাটা স্পষ্ট হয় বরাদ্দের বেঁধে দেওয়া ঊর্ধ্বসীমার হিসেবে। যত শিশু ভর্তি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া যাবে, এটাই নিয়ম। এক দিকে সব শিশুকে স্কুলে আনার জন্য মুখর সর্বশিক্ষার স্লোগান, অন্য দিকে ধরেই নেওয়া হয়েছে, উপস্থিতি ৮০ শতাংশের উপরে যাবে না! শিশুরা যেহেতু কণ্ঠহীন, তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের মা-বাবাদের বেশির ভাগেরই গলায় জোর নেই এবং যাঁদের জোর আছে, তাঁদের বাচ্চাদের জন্য দোকানে সাজানো থাকে চিপ্স, কুড়কুড়ে, বিস্কুট। অতএব সরকারও চলে আপন খেয়ালে। যে যত অসহায়, সরকারি নীতি তার প্রতি ততটাই মমতাহীন, অন্যায্য। শিশুদের বঞ্চনার পাশাপাশি মিড-ডে মিলের রাঁধুনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য এর আর এক প্রমাণ। রান্নার জন্য এঁদের যে মজুরি দেওয়া হয়, সেটা ভর্তি হওয়া শিশুর হিসেবে। যদিও প্রকল্পটা চালান প্রধানত স্ব-রোজগার দলের মহিলারা এবং সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়টার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মজুরির হিসেবটা হয় ব্যক্তি হিসেবে, দল হিসেবে নয়: ২৫ জন শিশু ভর্তি পর্যন্ত এক জন রাঁধুনি; ২৬ থেকে ১০০-র দু’জন; ১০১ থেকে ২০০-র জন্য তিন জন, ইত্যাদি। রাঁধুনি প্রতি মজুরি ১০০০ টাকা (মাসে ২২ দিন হিসেবে)। কিন্তু রান্নাটা যেহেতু দলের সদস্যরা মিলিত ভাবে করেন, মজুরির টাকাটাও তাঁদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় এবং তাঁরা যা পান, সেটা প্রায় না-পাওয়ারই সমান। কিন্তু তর্কের খাতিরেও যদি এক জনের মজুরিটাই আমরা ধরি, তা হলে দেখা যাচ্ছে, এক জন রাঁধুনি দৈনিক সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা (প্রকৃতপক্ষে ৪৫.৪৫ টাকা) পেতে পারেন (১০০০ টাকা, মাসে ২২ দিন কাজ)। সরকার দয়ালু। তার একটা ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি আছে, যেটা এখন কৃষিক্ষেত্র অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ১৯৩ টাকা। এ টাকা জীবনকুশলতার জন্য পর্যাপ্ত নয়, এটা মেনে নিয়েই ন্যূনতম মজুরি ঘোষিত হয়— এটা কেবল জৈবিক বেঁচে থাকার জন্যই। কিন্তু মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দটা এই ন্যূনতম মজুরি অপেক্ষাও ৭৬ শতাংশ কম! এবং আদৌ যদি সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে থাকা এই রাঁধুনি মহিলাদের জন্য কারও কোনও চিন্তা থাকে, তা হলে তাঁর উদ্বেগ বেড়ে ওঠার কথা। ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে তাঁদের পাওয়া মজুরির ব্যবধান বেড়েই চলেছে, ২০০৬ সালে বর্তমান লেখকদের এক জনের করা হিসেবে এই ব্যবধান ছিল ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ, টাকার অঙ্কটা বাড়লেও আনুপাতিক দিক থেকে মজুরিটা কমছে। এই কথাটাও বলে রাখা ভাল যে, আমরা তুলনাটা করছি অদক্ষ কৃষি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে, যদিও রাঁধুনিদের কাজটা অর্ধদক্ষ চরিত্রের এবং সেই হিসেবটা নিলে তাঁদের বঞ্চনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
কেন তাঁরা এই বঞ্চনাটা মেনে নিচ্ছেন, সে প্রশ্নের জবাবে উঠে আসে অন্য বঞ্চনার কাহিনি: এ টাকায় তাঁদের সংসার চলে না ঠিক, কিন্তু প্রাইভেট মাস্টারের টাকা বা রোগ-অসুখে চিকিৎসার কিছুটা অংশ তাঁরা এ থেকে মেটাতে পারেন। অথচ, এগুলোর জন্য তো তাঁদের খরচ করার কথা নয়, নাগরিকদের নিখরচায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা তো কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজের মধ্যেই পড়ে। অথচ, এই পরিষেবাগুলি কেনার জন্য সমাজের বঞ্চিততম মহিলাদের প্রাক্-আধুনিক যুগের মজুরি-বঞ্চনার শিকার হতে হয়। হতে হয়, কেননা, এঁদের জন্য বলবার কেউ নেই। যেমন বলবার কেউ নেই স্কুলের শিশুদের জন্য। মনে পড়ছে, এক বার বেশ ক্ষমতাশালী এক নারীবাদী নেত্রীর কাছে অনুরোধ জানানো হয় বিষয়টা নিয়ে ‘একটু দেখতে’। উত্তরটা হতভম্ব করেছিল: ‘তা-ও তো কিছু পাচ্ছে!’ হ্যাঁ, কিছু পাচ্ছে। তার জন্য তিন গুণ বেশি খাটতে হচ্ছে। পরম্পরাগত ভাবে করে আসা ঘরের কাজ, পরের কাজের বোঝার উপর যোগ হয়েছে ‘দেশের কাজ’। যে কোনও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ প্রকল্পেই ‘দেশের কাজ’টা পড়ে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন মহিলাদের ঘাড়ে। প্রতিবাদ তো দূর, যাঁদের কথার ওজনে এ অবস্থাটা খানিকটা বদলাতে পারত, সেই সুধীজন, বিদ্বজ্জনরাই যখন এটাকে ভবিতব্য বলে মেনে নেন, তখন সমাজের বঞ্চিততমদের কপালে শোষণ ছাড়া কী-ই বা অবশিষ্ট থাকে?
একই অবহেলায় দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কপালে জোটে পাতলা ডাল, বিস্বাদ ব্যঞ্জন। মিড-ডে মিল প্রকল্প স্কুল ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে না উঠে, হয়ে ওঠে ভুখাদের দিকে অবহেলায় ছুড়ে দেওয়া সমাজের ক্ষমতাবানদের ভুক্তাবশিষ্ট প্রসাদ। উচ্চবর্গ সমাজ নিজেদের তাৎক্ষণিক ভাল-টা বুঝতে গিয়ে বিসর্জন দেয় দেশের ভবিষ্যৎ, যে দেশের যাবৎ পশ্চাৎপদতার পিছনে আছে সমাজের সবচেয়ে অসহায়দের সুযোগ বঞ্চনা।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত |
|
|
|
|
|