নারীনিগ্রহ, গণ-ধর্ষণ ও ধর্ষণান্তে হত্যার উপর্যুপরি ঘটনায়, বিলম্বে হইলেও, রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের নিদ্রাভঙ্গের উপক্রম দেখা দিতেছে। ধর্ষণ-উপদ্রুত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় নূতন কয়েকটি থানা, রাজ্যব্যাপী বেশ কয়েকটি মহিলা-থানা গড়ার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের জন্য এক জন অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেলের পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হইয়াছে। ধর্ষণের ঘটনাগুলি যে সাজানো নয়, বাস্তব, এবং অসহায় মহিলারাই যে সেই অনাচারের শিকার, এই সত্যটি উপলব্ধি করার একটি লক্ষণও হয়তো প্রশাসনের মধ্যে দেখা দিতেছে, যদিও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের তরফে এখনও এগুলিকে ‘শাসকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত’ আখ্যা দেওয়ার হাস্যকর প্রবণতা বিদ্যমান। বিলম্বিত এই সব প্রশাসনিক পদক্ষেপ স্বাগত। তবে এগুলি শেষ পর্যন্ত কতটা ফলপ্রসূ হইবে কিংবা ইহাতে নারীনিগ্রহ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সামগ্রিক কৃত্যটি কতটা সম্পন্ন করা যাইবে, সে বিষয়ে সংশয় থাকিয়াই যায়। সংশয়ের একটি বড় কারণ নিচু তলায় পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মী-অফিসারের অভাব। থানায়-থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ প্রধানত সাব-ইনস্পেক্টররা করিয়া থাকেন। উত্তর চব্বিশ পরগনায় অন্তত ৪০০ সাব-ইনস্পেক্টর থাকার কথা, আছেন ১৭৫ জন, অর্থাৎ ২২৫টি পদ শূন্য পড়িয়া আছে। সমগ্র রাজ্যের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি দুই হাজার। মহিলা এসআই আছেন মাত্র ৯৮ জন, যেখানে ৩৫৮ জন থাকার কথা। নারীনিগ্রহ ও ধর্ষণের মতো অপরাধের মোকাবিলা এত স্বল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়া কেমন করিয়া হইবে? নিগৃহীত মহিলারাই বা কাহার কাছে অভিযোগ জানাইবেন, যদি পর্যাপ্তসংখ্যক মহিলা এসআই না থাকেন? নিচু তলায় পুলিশের পদ খালি রাখিয়া মাথার উপর ওজনদার অফিসার বা আমলা নিয়োগ করিলেই সমস্যার সুরাহা হইবে না। বিশেষত যখন পুলিশের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগই হইল, ধর্ষক তথা নিগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে তৎপর না-হওয়া। যথেষ্ট সংখ্যায় অফিসার বা কনস্টেবল নাই, এই অজুহাত দিয়া থানা-কর্তৃপক্ষ অনায়াসে অপরাধীদের গ্রেফতার করা কিংবা পিছু ধাওয়া করার দায় এড়াইতে পারে। আর অভিযুক্তদের যদি পাকড়াও করিয়া বিচারের জন্য কাঠগড়াতেই তোলা না যায়, তবে তাহাদের দোষ প্রমাণ এবং শাস্তির সম্ভাবনা তো আরও সুদূর হইয়া ওঠে। অপরাধীরা এই সুযোগেই ধর্ষিতাকে ভয় দেখাইতে পারে, অভিযোগ প্রত্যাহারে চাপ দিতে পারে, অভিযোগ করার ‘অপরাধে’ দ্বিতীয় দফায় ধর্ষণ করিয়া তাহাকে হত্যাও করিতে পারে। উত্তর চব্বিশ পরগনায় ইহাই ঘটিয়া চলিয়াছে।
জেলা জুড়িয়া ফ্লেক্স-ব্যানার টাঙানো, মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত সভা কিংবা মহিলাদের লইয়া পাড়া-কমিটি তৈয়ারির যে-সব কর্মসূচির কথা রাজ্যের পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্র দফতরের মুখে শুনা যাইতেছে, তাহা বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রভূত, যদি না পুলিশ অপরাধীদের ধরিতে সক্রিয় হয়। আর সে জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী এবং অবশ্যই থানায়-থানায় মহিলা পুলিশ, এমনকী স্বতন্ত্র মহিলা-থানাও। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করিলেও তাহাদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য, লঘু অপরাধের চার্জশিট দিয়া ছাড়া পাওয়ার যে সম্ভাবনা পুলিশ তৈয়ার করে, তাহাও অত্যাচারিতদের মনে ভরসা জোগাইতে পারে না। নারীনিগ্রহ রুখিতে গ্রামাঞ্চলে সিসিটিভি মোতায়েন অপেক্ষা পুলিশের আপন কাজে মন দেওয়া কিঞ্চিৎ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। |