ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সৌম্য চেহারা। গলায় পট্টবস্ত্র। মঞ্চে গলা ছেড়ে গাইছেন কবিয়াল। সঙ্গত করছেন বাজিয়েরা। দোহাররা ধুয়া ধরছেন।
না, ‘জাতিস্মর’ ছবির দৃশ্য নয়। এখনও রাজ্যের নানা প্রান্তের গ্রামে কবিগানের আসর বসে। আগের মতো অত বেশি সংখ্যায় নয়, দর্শকদের ভিড়ও উপচে পড়ে না আর, আক্ষেপ করছিলেন মনোরঞ্জন সরকার। কবিগানের ধারাকে আজও যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মধ্যমগ্রাম-সোদপুর রোডে দক্ষিণ তালবান্দার বাসিন্দা মনোরঞ্জনবাবু ৩৫ বছর ধরে কবিগান গাইছেন। নিজেকে পরিচয় দেন লোককবি হিসেবে। তাঁর আসল পদবি বসু হলেও কবিগানের ‘সরকার’ থাকতে থাকতে এখন এটাই তাঁর পদবি হয়ে গিয়েছে।
রীতিমতো নাড়া বেঁধে শিখেছেন কবিগান। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে প্রথম নিশিবাবু, রসিকবাবুর কবিগান শোনেন মনোরঞ্জন। তারপর বেলঘরিয়ার নিমতায় সুরেন্দ্রনাথ সরকারের কাছে নাড়া বাঁধেন। সেখানেই আলাপ হয় দোহার কালাকেষ্টর সঙ্গে। এরপর বাংলাদেশে গিয়ে খুলনা ও গোপালগঞ্জে কালিদাস সরকারে কাছে ১২ বছর তালিম নেন। কবিয়াল মনোরঞ্জনবাবুর একটি দলও আছে। স্ত্রী কানন বসুও সেই দলের সদস্যা। মহারাষ্ট্র, বিহার, দিল্লি, ওড়িশা, বৃন্দাবন, উত্তরাখণ্ড, নৈনিতাল, ত্রিপুরা এমনকী বাংলাদেশেও তিনি কবিগান করেছেন। |
গানে মগ্ন মনোরঞ্জন সরকার। |
প্রৌঢ় মনোরঞ্জনবাবুর আক্ষেপ, “শহরাঞ্চলে আসরের জন্য মাঠ পাওয়া যায় না। আর শহরের ব্যস্ত মানুষ এ গান বেশিক্ষণ শুনতেও চান না। গ্রামের জনপ্রিয়তা থাকলেও, অনুষ্ঠানের সময় এখন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।” কেন কমেছে কবিগানের জনপ্রিয়তা? মনোরঞ্জনবাবু জানান, ‘‘কবিগানের পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গীয় দুটি ধারা। পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা কলকাতার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে। সেই ধারায় কবিগানের আসরে ব্যক্তিকুৎসা, ব্যক্তিগত আক্রমণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি পূর্ববঙ্গীয় ধারায় প্রধানত লোকসংস্কৃতি, লোকাচার, সামাজিকতা ও শিক্ষামূলক বিষয়ের উপরে গান বাঁধা হত। ফলে পূর্ববঙ্গীয় ধারার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কমেছে।”
এখন যে কবিগান শোনা যায়, সেটাও পূর্ববঙ্গীয় ধারার সংশোধিত রূপ বলে মনে করেন মনোরঞ্জনবাবু। পূর্ববঙ্গের কবিয়াল ডা. দীনেশচন্দ্র সিংহের হাত ধরে সেই ধারা বিকাশলাভও করে ও পরে তারক গোঁসাই তার সংস্কার করেন। সেই ধারার ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছেন বেথুয়াডহরির অমূল্য সরকার, বেলঘরিয়ার সুরেন্দ্রনাথ সরকার, সাতগাছিয়ার শ্রীনিবাস সরকার, ঠাকুরনগরের নারায়ণ বালা, প্রমুখ শিল্পী। বাংলাদেশের বাগেরহাট নিবাসী রাজেন্দ্র সরকার বা পাগল রাজেনকে এখনও কবিসম্রাট বলা হয়।
তবে বাংলার সংস্কৃতির মূলস্রোত থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে কবিগান। বাংলার পুরনো দিনের গান নিয়ে গবেষণা করেন দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি, এঁদের কবিত্বশক্তি ছিল। অ্যান্টনি প্রথম প্রথম অন্যকে দিয়ে গান বাঁধাত। পরে নিজেই লিখত গান। কবিদের লড়াই খেউড়ের অঙ্গ ছিল না, তাঁরা পরস্পরকে আক্রমণ করতেন রামায়ণ, মহাভারত, সংস্কৃত সাহিত্যের ভিত্তিতে।” তাঁর আক্ষেপ, অনেকেই তরজা আর কবিগানের তফাত বোঝেন না। ফিল্ম-নাটকে কবিগানের নামে তরজা বা খেউড় চলে।
কী ভাবে হয় কবিগান? কবিয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সঙ্গতকারী ও দোহাররা বসে থাকেন। কবিয়াল উঠে দাঁড়িয়ে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলে শুরু করেন গান। গান শুরু হয় মূলত ‘বন্দনা’ দিয়ে। দু’জন কবিয়াল থাকলে জমে ওঠে গানের লড়াই। তবে এর জন্য দরকার দীর্ঘদিনের তালিম। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রপাঠ ও নানান বিষয়ে পড়াশোনা আর কাব্যপ্রতিভার দরকার হয়। পাশাপাশি শিখতে হয় মঞ্চ উপস্থাপনার মতো নানা বিষয়ও। মনোরঞ্জনবাবুর মতো অভিজ্ঞ কবিয়ালরা মাঝে মাঝে কর্মশালা করেন। কবিগানের মরসুম হল দুর্গাপুজো থেকে বৈশাখ মাস। মরসুমে ১০০-১১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করেন তাঁরা। অনুষ্ঠানপিছু ৮-১২ হাজার টাকার
বায়না হয়।
কবিগানের প্রসারের জন্য ২০০৬ সালে রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসের উদ্যোগে বনগাঁয় তৈরি করা হয়েছে কবিগান অ্যাকাডেমি। সেখানে বিভিন্ন শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ পড়ানো হয়। উপেনবাবু বলেন, “কবিগানকে সমৃদ্ধ করতে এবং ভারত-বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে একে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।” অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বনগাঁতে যে কবিগান অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে সেখানে কী পড়ানো হবে তার পাঠক্রম তৈরির কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ওখানে কবিগান নিয়ে গবেষণারও ব্যবস্থা রয়েছে। উপেনবাবু বলেন, “শিক্ষিত কবিয়ালরা সঠিকভাবে বিষয়বস্তু নির্বাচন করে গান গাইলে শহরের মানুষও ফের কবিগান শুনবেন বলেই আমরা মনে করি।” জাতিস্মর ছবি কবিগান নিয়ে ফের উৎসাহ জাগায় কিনা, এখন তা-ই দেখার। |