দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার শিল্পীর তৈরি হাতের কাজ বিদেশের বাজারে বিক্রির সম্ভাবনায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে দিন কাটাচ্ছেন মোখাশিল্পীরা। মোখা শিল্পকে বিশ্ববাজারে পরিচিত করাতে ইউনেসকো উদ্যোগী হওয়ায় কুশমন্ডি ব্লকের মহিষবাথান গ্রামের হস্তশিল্পীরা আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। পূর্বপুরুষদের ধারা বজায় রেখেই বাঁশ-কাঠ খোদাই করে দেব-দেবী ও নানা জীবজন্তুর মুখোশ টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। বাজারের অভাবে স্থায়ী রোজগারের উপায় নেই বলে তাঁদের অভিযোগ। বছরের বেশ কিছুটা সময় দিনমজুরের কাজ করাই বর্তমানে তাঁদের উপার্জনের অন্যতম বিকল্প।
১৯৯৫ সালে দক্ষিণ দিনাজপুর সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়ে পথ চলা শুরু হয় মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্পী সমবায় সমিতির। সমিতির সম্পাদক পরেশচন্দ্র সরকার বলেন, “বর্তমানে সমিতি সদস্য দু’শো ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদিও সবাইকে কাজ দেওয়া যায় না। মেলা ও প্রদর্শনীর মরসুমে রোজ গড়ে ১০-১৫ জন শিল্পীকে মোখা তৈরির কাজ দেওয়া সম্ভব হয়। কেননা, ওই সময় এক জন হস্তশিল্পী বাঁশ-কাঠের মোখা খোদাই করে দিনে ৯০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারেন। অন্য সময় বেকার শিল্পীরা অন্যের জমিতে কাজ খুঁজতে বেরিয়ে যান।” |
সম্প্রতি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে শিল্পোন্নয়ন নিগমের সহায়তায় মোখাশিল্পকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরতে উদ্যোগ শুরু হয়। গত বছর ১৬ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতা সায়েন্স সিটিতে মোখাশিল্প প্রদর্শনীর সময় আকৃষ্ট হন বিদেশি উদ্যোগপতিরা। জেলা শিল্প দফতর জানিয়েছে, সেই সময়েই ইউনেসকোর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশ বিদেশের এয়ারপোর্ট থেকে বাণিজ্য কমপ্লেক্সে রাজ্য সরকারের তৈরি বিশ্ব বাংলা স্টলেও কুশমন্ডির মোখাশিল্প প্রদর্শনের উদ্যোগ চলছে।
জেলা শিল্পকেন্দ্র ম্যানেজার তাপস রায় বলেছেন, “ইউনেসকোর মাধ্যমে মহিষবাথানের মোখাশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি পেল। ওরাই শিল্প বিপণনে উদ্যোগী হয়েছে।” প্রশাসন সূত্রের খবর, ইউনেসকোর হয়ে এক সংস্থা কুশমন্ডির মহিষবাথানে গিয়ে সমীক্ষা করেছে। ২২-২৪ জানুয়ারি কলকাতায় বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছেন মহিষবাথানের ১০ জন হস্তশিল্পী। বাঁশ কেটে বাটাল, ছেনি, হাতুড়ি দিয়ে নানা রকম মুখের অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে দক্ষ হস্তশিল্পী ধ্রুব সরকার, পরমেশ্বর সরকার, গৌরাঙ্গ সরকার। মাধ্যমিক পাশ করে আর্থিক অভাবের কারণে ধ্রুবর আর পড়া হয়নি। সমিতি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ধ্রুব, গৌরাঙ্গরা বাঁশ-কাঠ খোদাইয়ের শিল্প আকড়ে ধরে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখছেন। ধ্রুবরা বলেন, “বাঁশের একটি মুখোশ তৈরি করলে ৫০ টাকা। মরসুমের সময় সারা দিনে ৬টি মুখোশ তৈরি করতে পারলে ৩০০ টাকা আয়।” স্থানীয় প্রবীণ শিল্পী শঙ্কর সরকারের ৬৮ বছর বয়স। এলাকায় তিনিই একমাত্র, যিনি কেন্দ্রীয় সরকার থেকে মাসে হাজার টাকা হস্তশিল্পীর পেনশন পান। তিনি বলেছেন, “রাজ্য আমাদের শিল্পকর্মে নজর দেওয়ায় আমরা ভরসা পাচ্ছি।”
সমবায় সমিতিতে গামারি, পাকুড়, মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি ৫০০টির মতো ভদ্রকালী, নরসিংহ, চণ্ডী, রাবণ, হনুমান, বাঘ, রাক্ষসের মোখা মজুত রয়েছে। দেওয়ালে ঝোলানো মুখোশ থেকে বাঁশ খোদাই করে তৈরি ঘর সাজানোর ফুলদানি ও নানা শিল্পকর্ম নিয়ে ফি বছরের মত রাজ্যের বিভিন্ন মেলায় প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য তাঁরা এখন প্রস্তুত। সমবায় সমিতি সম্পাদক পরেশবাবু বলেন, “আগামী ৮-১৪ ফেব্রুয়ারি গোয়ায় হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে আমরা ডাক পেয়ে যাচ্ছি।” তবে মহিষবাথানে কোনও বিদেশি পর্যটক মোখা কিনতে চাইলেও ইউনিস্কোর শর্ত মেনে বর্তমানে শিল্পসামগ্রী বিক্রি বন্ধ রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। |