এক ক্রিকেট টিমকে শুভেচ্ছা জানাতে মঞ্চে এক ডাকে উপস্থিত ফুটবল থেকে সাঁতার, হকি থেকে দাবা এমন দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে, না শুনেছে? বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে তো কখনও হয়ইনি, ভারতেও আজ পর্যন্ত কখনও হয়েছে কি না সন্দেহ। যেখানে ক্রিকেটের জন্য এক মঞ্চে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যাথলেটিক্স, তিরন্দাজি, দাবা, শ্যুটিং, ফুটবল, হকি কে নয়?
লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র টিমের শুভমকামনায় বিশাল একশো ফুটের ফ্লেক্সে মন দিয়ে সই করছেন টেনিসের অতীত নক্ষত্র নরেশ কুমার। বাংলা অধিনায়ককে দেখে সস্নেহে বলে ফেলছেন, “দেখো, তোমরা রঞ্জিটা জিতবে। মন বলছে।”
বঙ্গ অধিনায়ক স্বয়ং মঞ্চে হাত ধরে নিয়ে আসছেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলা, সেমিফাইনাল, ভিনরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ জাতীয় শব্দগুচ্ছ কানে গেল কি গেল না, সাতাত্তরের পিকে মুহূর্তে সাতাশ! ছিটকে আসে তাঁর বিখ্যাত ভোকাল টনিকের টুকরো-টাকরা, “তোমরা সব ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। আমি বলছি, বিস্ফোরণ এখনও হয়নি। কোনও ভাবে ছাড়বে না অপোনেন্টকে। জেনো, আগামী কয়েকটা দিন আমার ঘুম হবে না!” সেই পুরনো তেজ পিকে অনেকটাই হারিয়েছেন। কিন্তু যতটুকু পাওয়া গেল, সেটাও বড় কম নয়।
আরে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কাকে ডাকছেন মঞ্চে? ওহ্, শিবশঙ্কর পাল। তাঁকে কেউ খেয়ালই করেননি, শুধু সৌরভ বাদে। ডায়াসে বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের দিনব্যাপী সইয়ের রেপ্লিকা তখন দেওয়া হচ্ছে লক্ষ্মী, অশোক মলহোত্রদের। সৌরভ, জগমোহন ডালমিয়ার হাত দিয়ে। কিন্তু সৌরভ নিজে সরে গেলেন, এগিয়ে দিলেন প্রত্যাবর্তনের শিবকে। ঠিক যে ভাবে বর্তমানকে এগিয়ে দেয় অতীত।
ব্যতিক্রমী সংবর্ধনা মনে হচ্ছে? এতটুকু ভুল নয়। ক্লাব হাউসের বাইরে বিশাল হোর্ডিংয়ে লেখা: ‘এ বার এগারো জনের দাদাগিরি দেখবে গোটা ইন্ডিয়া’। আর ক্লাব হাউসের ভিতরে সিএবি-সন্ধেয় যা যা ঘটল, যে ভাবে বিভিন্ন ক্রীড়াক্ষেত্রের ব্যক্তিত্বরা শেষ চারের আগে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন অকাতরে, নিঃসন্দেহে তা ব্যতিক্রমী। |
যেখানে দাবার দিব্যেন্দু বড়ুয়া বলে গেলেন, “হ্যাটস অফ টু লক্ষ্মী-অশোক। মনে প্রাণে চাই ওরা রঞ্জি জিতুক।” যেখানে বাংলার সেমিফাইনাল যুদ্ধের প্রাক্কালে অলিম্পিক শ্যুটার জয়দীপ কর্মকারের মনে পড়ে গেল লন্ডন অলিম্পিকে সেমিফাইনাল টাইয়ের কথা। লক্ষ্মীকে উৎসাহ দিয়ে বলেও দিলেন, “এ বার আবার হবে। বাংলা আবার পারবে।” যেখানে বাঙালি তিরন্দাজ রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১০ তিরন্দাজি বিশ্বকাপের কথা বর্ণনা করে লক্ষ্মীদের মনে করিয়ে দিলেন, “কোয়ার্টার ফাইনাল প্রাথমিক একটা ব্যাপার। আসল সেমিফাইনাল, ফাইনাল।” যেখানে ইংলিশ চ্যানেল পার করা বুলা চৌধুরী নব্বইয়ের দশকে সাফ গেমসে তাঁর স্বর্ণপদক জয়ের কাহিনি শুনিয়ে লক্ষ্মীকে বলে দিলেন, “এত দূর গিয়েছ যখন, শেষ দেখে ছাড়বে।” যেখানে সমস্ত ক্রীড়া-ধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ্মীরতন শুক্লদের কাছে আর্জি পেশ হল যে বহু দিন বলার মতো কিছু ঘটেনি বাংলা ক্রিকেটে। এ বার রঞ্জি এনে ভারতকে দেখিয়ে দাও, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরেও ক্রিকেটটা খেলতে পারে বাংলা।
এবং সংবর্ধনার মেজাজ যদি ব্যতিক্রমী হয়, তা হলে একজন ব্যতিক্রমও থাকলেন।
ইনি অমল দত্ত।
আবার সেই ব্যতিক্রমকে ভুলিয়ে সংবর্ধনার স্ব-মেজাজও ফিরিয়ে আনলেন আর একজন। তাল কাটতে না দিয়ে।
ইনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
ঘণ্টাখানেকের অনুষ্ঠান শেষেও দেখা যাচ্ছিল উপস্থিতরা যতটা উচ্ছ্বসিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বার্তায়, ততটাই বিরক্ত অমল নিয়ে। কারণ তাঁর পনেরো-কুড়ি মিনিটের বক্তৃতায় একবারের জন্যও বাংলা ক্রিকেট ছিল না। পুরোটাই ফুটবল ও তাঁর নিজের জীবনের বঞ্চনার কাহিনি। কথা ছিল, পিকে-র মতো তিনিও ভোকাল টনিক দেবেন লক্ষ্মীদের। অমল সেখানে চলে গেলেন পুসকাসের হাঙ্গেরিতে, চলে গেলেন বাঘা সোম আর ছোনে মজুমদারে। তাঁর ভাষণে না এল ভোকাল টনিক, না এল ক্রিকেট। বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকেও তো মঞ্চে ডাকার সময় দেখা গেল না। প্রথমে তাঁর নাম ঘোষণা না হওয়ার জন্যই কি চলে গেলেন সম্বরণ? বাংলাকে দু’বার রঞ্জি ফাইনালে তোলা দীপ দাশগুপ্ত প্রথমে ছিলেন, পরে নেই। অ্যাথলেটিক্সের কুন্তল রায়ের বক্তৃতাও বেমানান শোনাল। কিন্তু সবই তুচ্ছ হয়ে গেল সংবর্ধনার শেষ অঙ্কের ঔজ্জ্বল্যে।
বলা ভাল, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঔজ্জ্বল্যে। সৌরভ তিনটে ব্যাপার বলে গেলেন লক্ষ্মীদের। এক, তোমরা তিনটে ভাল টিমকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছ। উত্তরপ্রদেশ, চেন্নাইয়ে তামিলাড়ু, রেলওয়েজ। তার তুলনায় ইন্দৌরে মহারাষ্ট্র অনেক দুর্বল। দুই, জেতো বা হারো, তোমরা আমাদের কাছে প্রিয় টিমই থাকবে। আমাদের বাংলা-ই থাকবে। তৃতীয় তথা শেষটা অধিনায়ক লক্ষ্মীকে। “মিডিয়া জিজ্ঞেস করছিল কতটা চাপে থাকবে বাংলা। লক্ষ্মীকে একটা কথা বলতে চাই। মনে রাখিস, আমরা চারটে বছর একসঙ্গে অবনমন বাঁচানোর যুদ্ধ চালিয়েছিলাম। ড্রেসিংরুমে তখন তোর সঙ্গে আমিও ছিলাম। তাই আজ যে ভাবে প্রশংসা চলছে, সেগুলো উপভোগ কর। ছেলেদেরও বল সেমিফাইনাল উপভোগ করতে,” বলে দিলেন সৌরভ। অনুষ্ঠান শেষে লক্ষ্মীকে ডেকে সৌরভ আবারও উৎসাহ দেন। লক্ষ্মীর বাংলা, প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের কাছে পুনরাবিষ্কারের বাংলা। যে সংসারে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন শিবশঙ্কর পাল, সৌরাশিস লাহিড়ী। যে টিমের অধিনায়ককে সার্টিফিকেট দিয়ে দেন নির্দ্বিধায়। প্রেশার সিচুয়েশনে ম্যাচ বার করার জন্য।
যে সার্টিফিকেট সিএবি-ও মঙ্গলবার দিতে পারে সৌরভকে। একই কারণে। অমলের প্রকোপ, সম্বরণদের নিয়ে ছুটকো প্রশ্নে মাঝে বিপত্তিতে পড়া সিএবি-র সংবর্ধনার ‘ম্যাচ’ তো বার করে দিলেন ওই একজনই।
ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি!
|