মকর সংক্রান্তিতে ঢল চপলেশ্বরের মেলায় |
দেবমাল্য বাগচি • খড়্গপুর |
মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে ডেবরার বালিচকে প্রায় সাতশো বছরের পুরনো কেদারমেলায় চপলেশ্বরের ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে ঢল নামল মানুষের।
প্রতি বছরের মতোই এ দিন সকালে শুরু হয় চপলেশ্বর রূপী মহাদেবের পুজো। পুজো উপলক্ষে বসেছে মেলা। কথিত রয়েছে, ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাতে আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণে পরাজিত হয়েছিলেন সোলাঙ্কি রাজা দেবনাথ। রাজত্ব হারিয়ে আশ্রয় হারা রাজা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে থাকেন। সে ভাবেই এসে পৌঁছন ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরে। তখন মেদিনীপুর জেলাও ওড়িশার অর্ন্তগত ছিল। রাজা দেবনাথ ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরের থাকাকালীনই মহাদেবের থেকে স্বপ্নাদেশ পান। ওই স্বপ্নাদেশে রাজা দেবনাথকে মেদিনীপুর কেদারকুণ্ডু পরগণায় সামন্ত রাজাদের খট দস্যু ও পশ্চিমী চুয়াড়দের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার কথা বলা হয়। স্বপ্নাদেশ মতো রাজা চলে আসেন অধুনা কেদারমেলায়। এর পর যুদ্ধ করে ৭১৩ জন চুয়াড়ের মুণ্ডচ্ছেদ করেন বলে জনশ্রুতি। ওই ঘটনা থেকেই কেদারমেলার পাশেই পিংলা ব্লকে মুণ্ডমারি এলাকার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারনা। |
|
মকরের পুণ্যস্নান। কংসাবতীয় গাঁধীঘাটে মঙ্গলবার ভোরে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি। |
এর পরই এলাকার সামন্ত রাজারা দেবনাথ তথা বীরসিংহকে একশো বর্গ কিলোমিটার জায়গা দিয়ে রাজা হিসেবে সম্মান জানান। সন্তুষ্ট রাজা তখন ওড়িশার মহরাজ দ্বিতীয় ভানুদেবের থেকে সনদ নিয়ে রাজ্য স্থাপন করেন কেদারকুণ্ডুতে। পরবর্তীকালে রাজা বীরসিংহ একটি জলাশয়ে খুঁজে পান বিশালাকার শিবলিঙ্গ। সেই জলাশয়ের ধারেই একটু উঁচু জমিতে ১২৯৯ সাল নাগাদ রাজা বীরসিংহ ওই চপলেশ্বর মন্দির গড়ে তোলেন। তারপরের মকর সংক্রান্তি তিথিতে মহাদেবের পুজো ও ১৫ দিন ব্যাপী মেলার সূচনা করেন। তিনি ওই মন্দির দেখাশুনোর জন্য ওড়িশা থেকে ১১ জন পুরোহিতকে নিয়ে আসেন। অবশ্য ১৩৫৫ সালে বাংলার নবাব সামসুদ্দিন ইলিয়াস ওড়িশা আক্রমণ করলে মহারাজ তৃতীয় ভানুদেবের অনুরোধে রাজা বীরসিংহ তাঁকে বাধা দেন। তখন যুদ্ধে বীরসিংহ রাজার মৃত্যু হয়। এখন পুরোহিতদের উত্তরসূরি প্রায় ২৫ জন সেবায়েত এখনও ওই উত্সবের আয়োজন করেন প্রতি বছর। |
|
সেজে উঠেছে মন্দির। —নিজস্ব চিত্র। |
রীতি মেনে মকর সংক্রান্তিতে মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে দূর দূরান্ত থেকে বহু লোক এলেও মেলার দিন সঙ্কুচিত হয়েছে। এখন ১৫ দিনের বদলে মেলা বসে একদিনই। তবে শিবরাত্রি থেকে টানা ১৫ দিন মেলা আয়োজিত হয়। এ দিনও মকর সংক্রান্তির পুজো দিতে এসেছিলেন স্থানীয় বহু মানুষ। পুজো দিতে আসা বারুণিয়ার খোকন চক্রবর্তী বলেন, “বংশ পরম্পরায় আমি এই মন্দিরে পুজো দিয়ে আসছি। তেমাথানির অশোক হাজরার অভিযোগ, “মন্দিরের অবস্থা ভাল নয়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।” মন্দিরের আরও প্রচার প্রয়োজন বলে মনে করেন কলকাতার তুফানি সিংহ। বস্তুত, এখন মন্দিরের পুরনো সীমানা পাঁচিল আর নেই। নতুন পাঁচিল কিছু দিন আগেই হয়েছে। রঙ হয়েছে মন্দিরেরও। তবে চুন-সুরকি দিয়ে গড়া মূল মন্দির ও দু’টি নাট মন্দিরের কাঠামোর অবস্থা বেহাল। মন্দিরের পূর্ব দিকে থাকা সিদ্ধকুণ্ডরও একই দশা। বছর সাতেক আগে মন্দিরের কাছে জলাশয় শুকিয়ে গেলে ওই বিশালাকার শিবলিঙ্গের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মন্দির সংস্কারের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছে পরিচালক কমিটি। আগামী দিনে সেবায়েত ও বাইরের কিছু মানুষকে নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা। মন্দিরের সেবায়েত অসিত পণ্ডা, চণ্ডীচরণ মহাপাত্ররা বলেন, “আমরা ভক্তদের থেকে আসা অর্থ নিজেরা নিই না। সেগুলি জমিয়ে কোনও ভাবে মন্দির বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তবে সরকারি সাহায্য মিললে খুব ভাল হয়।” |
|