এই নিয়ে পাঁচ। বাম আমলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিলগ্নিকরণ হয়েছিল চারটি রাজ্য সরকারি সংস্থার। নতুন জমানায় এই প্রথম পাঁচটি সরকারি চা-বাগানে বেসরকারি বিনিয়োগ টানার চেষ্টায় ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে সোমবার। যে সিদ্ধান্তকে শিল্প-সংস্কার সম্পর্কে তৃণমূল সরকারের বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবেই দেখছে সংশ্লিষ্ট মহল।
এ রাজ্যে সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণ শুরু ২০০৩ সালে। সেই কাজে আর্থিক সাহায্য জুগিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারি সংস্থা ডিএফআইডি। তখন প্রাথমিক ভাবে ৩০টি সংস্থাকে বিলগ্নিকরণের জন্য বেছে নেওয়া হলেও প্রধানত সিটুর বাধায় তা মাত্র চারটিতেই আটকে যায়। এই চার সংস্থার অন্যতম গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। সিটুর সঙ্গে বহু টানাপোড়েনের পরে যার ৯০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করতে পেরেছিল বামফ্রন্ট সরকার।
রুগ্ণ সরকারি সংস্থার শেয়ার বিক্রির পিছনে বাম আমলে যে যুক্তি কাজ করেছিল, এ আমলেও সেই একই যুক্তি কাজ করছে। প্রথমত, একটানা লোকসানের বোঝা কমানো। যে পাঁচটি চা-বাগান বিক্রির বিষয়টি বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভার শিল্প বিষয়ক কমিটি, তার পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ২২৫ কোটি টাকা। বাগানগুলি চালাতে প্রতি বছর সরকারের কোষাগার থেকে ২৫ কোটি করে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে সোমবারই জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। সেই অপচয় ঠেকানোই সরকারের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয় যুক্তি, বেসরকারি পরিচালন ব্যবস্থা এনে রুগ্ণ বাগানগুলির উৎপাদন বাড়ানো। চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, বেসরকারি চা বাগানের ম্যানেজারদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন না সরকারি বাগানের ম্যানেজারেরা। কারণ, উৎপাদন বাড়িয়ে লাভ করার জন্য বেসরকারি বাগানের ম্যানেজারদের উপরে যে চাপ থাকে, সরকারি বেতনভুক ম্যানেজারেরা সেই চাপের মুখে পড়েন না। ফলে কাজ হয় দায়সারা ভাবে। ইউনিয়নের দাপটে শ্রমিকদের কর্মসংস্কৃতিও তলানিতে পৌঁছয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় চা পাতা চুরি, যথেচ্ছ গাড়ি ও জ্বালানি ব্যবহার এবং ভুয়ো বিল তৈরি করে টাকা তোলা।
এই দুই ব্যবসায়িক যুক্তির সঙ্গে একটা রাজনৈতিক যুক্তিও রয়েছে। তা হল: কর্মীদের রুজি রক্ষা। ধুঁকতে থাকা চা বাগানগুলিতে কর্মীদের বেতন-রেশন ইতিমধ্যেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০১১-র এপ্রিলে দার্জিলিঙের বাগানগুলিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকা করা হলেও সরকারি তিন বাগানে পুরনো হারেই মজুরি দেওয়া হচ্ছে। ডুয়ার্সের দু’টি বাগানে চুক্তিমতো বোনাসও হয়নি। পাঁচটি বাগানেই রেশন বকেয়া রয়েছে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। এই অবস্থা বেশি দিন চললে এলাকায় ক্ষোভ যে গভীর হবে, শাসক দল তা জানে। সেই কারণে বাগানগুলির এক জন কর্মীকেও ছাঁটাই করা যাবে না বলে সোমবারের বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই কর্মীদের সরকারের অন্য শূন্যপদে নিয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষতি সামাল দিতে চায় তৃণমূল।
তবে সেই রাজনীতিকে প্রত্যাশিত আখ্যা দিয়ে সরকারের সংস্কারমুখী সিদ্ধান্তের উপরেই গুরুত্ব দিতে চাইছে শিল্পমহল। তাদের মতে, ক্ষমতার গদিতে আড়াই বছর পার করার পরে যেন দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছেন মমতা। পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল সাফল্যের পরে মুম্বইয়ের সফল শিল্প সম্মেলন দিয়ে যার সূত্রপাত। তার পর নতুন শিল্প ও বস্ত্রনীতি ঘোষণা, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়ে নরম হওয়ার ইঙ্গিত, রাজনৈতিক আনুগত্যের তোয়াক্কা না-করে শিল্পমন্ত্রী বদল এবং শেষে বিলগ্নিকরণের মতো সংস্কার। লগ্নিকারীদের মতে, রক্ষণশীল মনোভাব হয়তো একেবারে ঝেড়ে ফেলেননি মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রেখেও শিল্পের জন্য পরিসর তৈরির চেষ্টা করছেন তিনি।
সরকারি কর্তারাও বলছেন, বাড়তি খরচ কমাতে লোকসানে চলা সংস্থার সংস্কারই যে একমাত্র পথ, তা বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে তিনটি সরকারি পরিবহণ সংস্থাকে মিশিয়ে দিয়ে একটি সংস্থা গড়ার দিকে এগোচ্ছেন তিনি। পরিবহণমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি পরিচালন পর্ষদ গড়ে সেই কাজ শুরু হয়েছে। এর পর হবে অতিরিক্ত ও অদক্ষ কর্মী বাছাইয়ের কাজ। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানার শেষ পর্বে প্রায় অকেজো হয়ে পড়া শিল্প পুনর্গঠন দফতর আবার কাজ শুরু করেছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (নিসকো), লিলি বিস্কুট, নিও পাইপস, ইলেকট্রো মেডিক্যাল অ্যান্ড অ্যালায়েড ইন্ডাস্ট্রিজের মতো সংস্থার পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া।
চা বাগানগুলির কত শতাংশ শেয়ার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যে ভাবে পরামর্শদাতা সংস্থার উপরে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতেও সংস্কারমুখী মানসিকতারই ইঙ্গিত পাচ্ছে শিল্পমহল। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, পরামর্শদাতা সংস্থা বললে একশো শতাংশ শেয়ারই বিক্রি করে দেওয়া হবে। লগ্নিকারীদেরও মতে, ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত পেশাদারি সংস্থার হাতে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় শ্রমিক সংগঠনগুলির আপত্তি। বাম আমলে যে কারণে লিলি বিস্কুট কারখানার বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েও শ্রমিক বিরোধী তকমার ভয়ে পিছিয়ে আসেন জ্যোতি বসু। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে রুগ্ণ চা বাগানগুলি নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছিলেন আগের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু গোড়াতেই সেগুলি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হলে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন সরকারের প্রথম সারির নেতারা। তাই বিষয়টি তখনকার মতো হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ বার ফের উদ্যোগী হওয়ার সময় উদ্বৃত্ত কর্মীদের অন্য পদে নিয়োগের কথা বলে সমালোচনার পথ গোড়াতেই বন্ধ করতে চেয়েছে সরকার। কিন্তু তার পরেও আরএসপি-র চা শ্রমিক সংগঠন ডুয়ার্স চা বাগান ওয়াকার্স ইউনিয়নের সভাপতি গোপাল প্রধানের কথায় “বেসরকারিকরণের পথে হাঁটায় শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হল। এত দিন বাগান দু’টি বন্ধ হয়নি। বেসরকারি হাতে পড়লে বন্ধ হবে।”
আরএসপি-র ইউনিয়নের পাশাপাশি ইনটাক ঐতিহাসিক ভাবে চা বাগান শ্রমিকদের মূল সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। তাদের চা শ্রমিক সংগঠন এনইউপিডব্লিউ-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনি ডারনাল বলেন, “বাগান চালাতে সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তবে বেসরকারি মালিক পক্ষ কতটা উন্নতি করতে পারবেন, তা নিয়ে আমরা সংশয়ে রয়েছি।” আর সিটুর দার্জিলিং জেলা সম্পাদক সমন পাঠকের মন্তব্য, “শ্রমিকদের স্বার্থেই আটের দশকে বাগানগুলি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরিচালনাগত ত্রুটির কারণেই বাগানগুলিতে ক্ষতি হচ্ছে। অন্য বাগানগুলি তো লাভ করছে!”
চা বাগান মালিকদের সংগঠন দার্জিলিং টি অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “এই সিদ্ধান্তে যেমন বাগানের পরিচালনা ভাল ভাবে হবে, তেমনই শ্রমিকরাও উপকৃত হবেন।” আর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে রাজ্যের শিল্পায়নের পক্ষে তা বড় বিজ্ঞাপন হবে বলেই মনে করছে শিল্পমহল।
শ্রমিক বিরোধিতার চাপ সামলে এই সংস্কারের পথে সরকার কতটা হাঁটতে পারে, সেটাই এখন দেখার। |
বিলগ্নি বৃত্তান্ত চা-বাগান |
দার্জিলিঙের তিন: রঙ্গরুক-সিডার, পানডাম ও রঙ্গারুন
ডুয়ার্সের দুই: হিলা ও মহুয়া
মোট জমি: • ২৬১৩ হেক্টর, •
বেদখল ৭০৬ হেক্টর, •
চা হয় ১০৯০ হেক্টরে
মোট কর্মী: প্রায় ৩২০০
মোট লোকসান ২২৫ কোটি |
আগের চার |
• এঙ্গেল ইন্ডিয়া মেশিন টুলস
• ওয়েস্ট বেঙ্গল কেমিক্যাল
• ভারত জুট মিল
• গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল |
|