ছোটবেলায় বিছানায় উপরে ভল্ট খাওয়া ছিল রোজিনার প্রিয় খেলা। ছোটবেলার খেয়াল যে পরবর্তী সময়ে এই মেয়েকে সোনা এনে দেবে, তা কেউ ভেবেছিল?
রায়নার শঙ্করপুর গ্রামে পেশায় রাজমিস্ত্রি কাশেম আলির তিন মেয়ে। দিন আনি দিন খাই সংসারে তিনি খুব কষ্ট করেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ছোট মেয়ের বিয়েটা কীভাবে হবে সেই নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ ছিল না। কিন্তু ছোট মেয়ে নিতান্ত সাধারণ মেয়ে নয়, সেটা কাশিম আলি মির্জা বুঝতে না পারলেও বুঝেছিলেন তাঁর ভাই হাসেম আলি মির্জা। এক সময় নিয়মিত খেলাধূলা করা হাসেম ভাইঝিকে বর্ধমানের জাতীয় সঙ্ঘের জিমন্যাশিয়ামে নিয়ে যান। এখানেই প্রায় চার বছর রোজিনা জিমন্যাষ্টিকের প্রথম পাঠ নেয়। এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানেই জেলা ও রাজ্য স্তরে পদক পেতে শুরু করে রোজিনা। সে তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী।
এরপর সময় আপন নিয়মে এগিয়ে গিয়েছে। রোজিনাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। |
রোজিনা মির্জা। —নিজস্ব চিত্র। |
শিয়ালদার রেলওয়ে জিমন্যাশিয়ামে সদ্য সমাপ্ত রাজ্য জিমন্যাস্টিক প্রতিযোগিতায় ২টি সোনা ও ১টি রূপো পাওয়া রোজিনা এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। সোনা এসেছে টেবিল ভল্ট ও আনইভন বার বিভাগে। রূপো এসেছে ফ্লোর এক্সাসাইজে। শুধু তাই নয়, মোট ৪৩.৪০ পয়েন্ট পেয়ে রাজ্যস্তরের ওই প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগতভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সে। এই জয়ের ফলে আগামী ১৮-১৯ জানুয়ারি গুজরাটে হতে চলা জাতীয় জিমন্যাস্টিকে যোগ দেওয়ার সুযোগও পেয়েছে রোজিনা। এরপরে আগ্রায় ২৯ জানুয়ারি থেকে হতে চলা জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপেও যোগ দেওয়ার কথা তার।
জাতীয় সঙ্ঘের সম্পাদক সুশান্ত চৌধুরী ও জিমন্যাস্টিক শিক্ষক মৌসুমি হাটি এবং মহম্মদ মোমিন বলেন, “রোজিনাকে দেখে প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল মেয়েটি পারবে।” তিনি জানান, যে ‘স্টেপ’ শিখতে অন্যান্যদের অন্তত ১৫ দিন লাগতো, রোজিনা সেটি ২-৩ দিনের মধ্যে শিখে যেত। সঙ্ঘের অপর দুই শিক্ষক করবী সাহা ও সুনীত দাসের কথায়, “অন্য শিক্ষার্থীরা যেগুলি করত, সেটাকে কি করে আরও ভাল ভাবে করা যায়, সেটারই চেষ্টা করত রোজিনা।”
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই রাজ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় জিমন্যাস্টিকে সর্বাধিক পদক পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কলকাতার সাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ডাক পায় সে। সেখানে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে থেকে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে রোজিনা। বর্তমানে জিমন্যাস্টিকের সঙ্গেই সল্টলেকের সুকান্তনগর হাইস্কুলে পড়ে রোজিনা।
এই খুদে প্রতিভাকে এগিয়ে যেতে সাহায্যের জন্য রোজিনা বেশ কিছু সাহায্য পেয়েছে। রায়নার আমানত সাহেব নামের এক চালকল মালিক একবার ওর জিমন্যাষ্টিক দেখে একলপ্তে ৬০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বাবা কাশেমআলিকে বলেছিলেন, “মেয়েকে বড় করো। হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের দেশকে একটা অলিম্পিক মেডেল এনে দেবে ও!” প্রচুর সাহায্য করেছেন প্রাক্তন জেলাশাসক সুব্রত গুপ্ত ও সভাধিপতি উদয় সরকারও। জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা নিজে রোজিনার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে তার হাতে নগদ অর্থ ও জিমন্যাশিয়ামের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তুলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আরও ভাল করে জিমন্যাষ্টিক শেখানোর জন্য ওকে রাশিয়ায় পাঠানোর কথা। মনে হয় এই মেয়েটি অনেক দুর যাবে।”
রোজিনা নিজে কী ভাবছে? তাঁর স্বপ্ন জিমন্যাস্টিকে দেশের সেরা হওয়া। তাঁর কথায়, “এখন তো অনূর্ধ্ব ১৭ বিভাগে রাজ্য সেরা হয়েছি। এরপর জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা পেতে চাই।” |