ফালাকাটায় জাতীয় সড়কের পরে কোচবিহার শহরের সুনীতি রোড। সোমবারও উত্তরবঙ্গে ফের বোমাতঙ্কে বন্ধ থাকল পথ। তবে এ ক্ষেত্রেও মেলেনি বিস্ফোরক। প্রায় ৪ ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ থাকার পর ব্যাগ খুলে দেখা যায়, ভেতরে রয়েছে জামাকাপড়, বিছানার চাদর, লুঙ্গি, মশারি, ওষুধ, বইখাতা ও প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরা মুড়ি। কোচবিহারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত বলেন, “আতঙ্ক ছড়াতে ব্যাগটি ওভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল কি না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
|
রবিবারই ফালাকাটার কাছে জটেশ্বরে বৈদ্যুতিক তার ও ঘড়ি লাগানো বোমার আকারের একটি বস্তু উদ্ধার হয়। তা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ালে জাতীয় সড়কে ৬ ঘণ্টা যান চলাচল ব্যাহত হয়। তার এক দিন পরেই কোচবিহারে ফের বোমাতঙ্ক ছড়ানোয় পুলিশ ও গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন কেএলও-কেই। ফালাকাটার ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সন্দেহ, কেএলও মূলত দু’টি কারণে বোমাতঙ্ক তৈরির ছক কষেছে। প্রথমত, কেএলও তাদের লিঙ্কম্যানদের কী ভাবে বোমা রেখে সরে পড়তে হবে তা দেখানোর মহড়া দিচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের অনেকের ধারণা। দ্বিতীয়ত, বোমাতঙ্ক তৈরি করে পুলিশি তৎপরতা কোথায়, কতটা রয়েছে তাও বোঝার চেষ্টা করছে কেএলও জঙ্গিরা।
সোমবার সকালে কোচবিহার শহরের ব্যস্ততম রাস্তা সুনীতি রোডে প্রধান ডাকঘরের কাছে একটি হালকা সবুজ রঙের বড় মাপের ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সকাল ৯টা নাগাদ পথচারীদের কয়েকজন তা দেখে হইচই করেন। এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের মাধ্যমে খবর পায় পুলিশ। পুলিশ গিয়ে প্রথমেই দ্বিমুখী রাস্তার যে দিকে ব্যাগটি পড়ে ছিল, সেখান দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বম্ব স্কোয়াড না-আসা পর্যন্ত রাস্তার অন্যদিক দিয়েও চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। পরিত্যক্ত ব্যাগের চারধারে বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা সুনীতি রোড বন্ধ থাকায় সকলকেই ঘুরপথে যাতায়াত করতে হয়। শেষ পর্যন্ত বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের কর্মীরা গিয়ে পরীক্ষা করে জানান, ব্যাগে কোনও বিস্ফোরক নেই। বেলা ২টো নাগাদ ব্যাগ খুলে দেখা যায়, ভেতরে রয়েছে জামাকাপড়, বিছানার চাদর, লুঙ্গি, মশারি, ওষুধ, বইখাতা ও প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ি। |
আগামী শুক্রবার ১৭ জানুয়ারি জঙ্গি সংগঠন কেএলও প্রস্তাবিত কামতাপুর এলাকায় বন্ধের ডাক দিয়েছে। জলপাইগুড়ির পাহাড়পুরের বিস্ফোরণের ঘটনার জেরে ওই বন্ধ ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা এড়াতে গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে। অসম ও বাংলাদেশ লাগোয়া কোচবিহারের প্রতিটি থানাকেও বাড়তি সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোচবিহার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গাড়িতে মাইক বেঁধে পরিত্যক্ত যে কোনও জিনিস পড়ে থাকার ব্যাপারে বাসিন্দাদের বারেবারেই সতর্ক করা হচ্ছে। পুলিশি প্রচারের জেরে অনেক বাসিন্দাদের অনেকেই অতি মাত্রায় সতর্ক রয়েছেন বলে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে স্পষ্ট হয়েছে। এ দিন যেখানে বোমাতঙ্ক হয়, সেই রাস্তার পাশে এনবিএসটিসির ডিপো, পেট্রোল পাম্প, প্রধান ডাকঘর, হাসপাতাল, একাধিক ব্যাঙ্ক রয়েছে। ঘটনাস্থল সুনীতি রোড শহরের বিভিন্ন অফিস আদালত ও স্কুল কলেজে যাতায়াতের অন্যতম রাস্তা। ব্যাগটি কোনও গাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছে নাকি কেউ ইচ্ছে করে রেখে গিয়েছে তাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। |
|
|
ব্যাগ পরীক্ষা করছেন বম্ব স্কোয়াডের কর্মী। |
পরীক্ষার পরে ব্যাগে মেলেনি বিস্ফোরক। |
|
তবে আতঙ্ক ছড়াতেই যে এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে তা বলেছেন রাজনৈতিক নেতারাও। ফালাকাটার তৃণমূল বিধায়ক অনিল অধিকারী বলেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই বোমাতঙ্ক তৈরি করছে। পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে।” সিপিএমের ফালাকাটার জোনাল সম্পাদক শ্যামলকলি বসুর অভিযোগ, “কেএলও ছাড়া ওই ভুয়ো বোমা রাখার কাজ অন্য কেউ করেনি বলে আমার মনে হয়। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে টাকা আদায় করা মূল লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।” তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের পূর্ত দফতরের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষও উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “আতঙ্ক ছড়াতে এ ধরনের কাজ করানো হচ্ছে বলে আমাদের সন্দেহ। পুলিশ সবই গুরুত্ব সহকারে দেখছে।”
|
ভয়ের ডায়েরি |
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩
পরিত্যক্ত ব্যাগে বোমাতঙ্ক কোচবিহার রাজবাড়িতে। জামা কাপড় উদ্ধার।
২৭ ডিসেম্বর ২০১৩
জলপাইগুড়ি ৪ নম্বর গুমটি এলাকায় পরিত্যক্ত ব্যাগকে ঘিরে বোমাতঙ্ক। আর্থিক সংস্থার নথি উদ্ধার।
২৮ ডিসেম্বর ২০১৩
কোচবিহারের বাণেশ্বরে পড়ে থাকা ব্যাগে বোমাতঙ্ক। ব্যাগ থেকে জামা কাপড় উদ্ধার।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৩
বোমাতঙ্ক ঘোকসাডাঙা স্টেশনে। পরে ব্যাগের মালিকের সন্ধান মেলে।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৩
• শিলিগুড়ির লেকটাউনে ব্যাগ কেন্দ্র করে আতঙ্ক। কয়েকটি জামা উদ্ধার হয়।
• মালদহের আদিনা স্টেশনে ঢোকার মুখে লাইনের পাশে একটি বাক্স দেখে বোমাতঙ্ক ছড়ায়। দুই ঘণ্টা ট্রেন বন্ধ থাকে। বাক্স থেকে সুইচ উদ্ধার হয়।
১ জানুয়ারি ২০১৪
আলিপুরদুয়ার বক্সা ফিডার রোডে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ ঘিরে বোমাতঙ্ক। খালি মদের বোতল উদ্ধার।
২ জানুয়ারি ২০১৪
• জলপাইগুড়ি ৪ নম্বর গুমটি এলাকায় জিনসের ব্যাগ থেকে বোমাতঙ্ক। প্রসাধনী জিনিস উদ্ধার হয়।
• জলপাইগুড়ি শান্তিপাড়ার বাস স্ট্যান্ডে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগকে ঘিরে বোমাতঙ্ক। ব্যাটারি চালিত পুতুল এবং গ্রিটিংস কার্ড উদ্ধার হয়।
• শিলিগুড়ির দোমাইলে আকাশবাণী ভবন লাগোয়া এলাকায় বোমাতঙ্ক। ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল এবং কিছু কাগজ উদ্ধার।
৮ জানুয়ারি ২০১৪
জলপাইগুড়ির দিশারী ক্লাবের সামনে একটি ব্যাগকে ঘিরে বোমাতঙ্ক। পোশাক উদ্ধার।
১০ জানুয়ারি ২০১৪
জলপাইগুড়ির জেলা বিচারকের বাড়ির সামনে রাস্তায় একটি ব্যাগকে ঘিরে বোমাতঙ্ক। পরে ব্যাগের মালিকের হদিস পায় পুলিশ।
১২ জানুয়ারি ২০১৪
• ফালাকাটা জটেশ্বরে শিশু উদ্যানের সামনে রাখা লাল কাগজে মোড়ানো গাছের ডাল, তার এবং ঘড়ি কেন্দ্র করে বোমাতঙ্ক।
• ধূপগুড়ির শালবাড়ির ডুডুয়া নদীর সেতুর নীচে পড়ে থাকা বস্তা ঘিরে বোমাতঙ্ক। বস্তায় চুল উদ্ধার।
১৩ জানুয়ারি ২০১৪
কোচবিহার সুনীতি রোডে পরিত্যক্ত ব্যাগ ঘিরে বোমাতঙ্ক। ব্যাগ থেকে পোশাক এবং মুড়ি উদ্ধার। |
|
সোমবার ছবিগুলি তুলেছেন হিমাংশুরঞ্জন দেব। |