আদতে ‘এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স’ হওয়ার কথা ছিল। হয়ে গেল ‘এয়ার ট্যাক্সি।’
হেলিকপ্টারের মাধ্যমে রাজ্যবাসীর কাছে আকাশপথে অ্যাম্বুল্যান্স-পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। বাস্তবের মাটিতে নেমে দেখা যাচ্ছে, মরণাপন্ন রোগীকে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসার মতো পরিকাঠামোই পরিবহণ দফতর জুগিয়ে উঠতে পারছে না। কারণ, হেলিকপ্টারে না থাকছে ভেন্টিলেটর, না অক্সিজেনের ব্যবস্থা!
ফলত আকাশযানটিকে আর যা-ই হোক, ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না। কারণ, আশঙ্কাজনক অবস্থার গুরুতর কোনও রোগীকে ওই কপ্টারে ওঠানোর প্রশ্ন নেই। বড়জোর তাতে করে দূর শহর বা গ্রামের অসুস্থ মানুষজনকে কলকাতায় আনা যেতে পারে ডাক্তার দেখানোর জন্য। অথবা কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য।
এবং এই মুহূর্তে সেই ‘সীমিত’ পরিষেবাই দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। সোমবার বিষয়টি নিয়ে পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন কলকাতার প্রথম সারির বারোটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিরা। আলোচনার পরে পূর্বাঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (এএইচইআই)-র সভাপতি রূপালি বসু বলেন, “আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, হেলিকপ্টারে আপাতত ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু হোক। অনেকটা এয়ার ট্যাক্সির মতো।” সেটা কী রকম?
রূপালিদেবীর ব্যাখ্যা, “হয়তো দূরের কোনও রোগী কলকাতার কোনও হাসপাতালে দেখাতে চান, বা সেখানে গিয়ে অপারেশন করতে চান। তিনি ফ্রি টু ফ্লাই, মানে শারীরিক ভাবে বিমানযাত্রায় সক্ষম হলে হাসপাতাল তাঁকে হেলিকপ্টারের টিকিট কেটে দেবে। খরচ ওঁকেই মেটাতে হবে। তবে তিনি অনেক তাড়াতাড়ি কলকাতায় চলে আসতে পারবেন।” কপ্টার-ভাড়ার খরচের বহরটা কেমন হবে?
পরিবহণমন্ত্রী জানান, হেলিকপ্টারে শান্তিনিকেতন-বালুরঘাট যেতে যত লাগে, আসনপিছু সর্বাধিক সেই হাজার দেড়েক টাকাই পড়বে। দফতর-সূত্রের বক্তব্য: যে সব রুটে এখন কপ্টার পরিষেবা চালু আছে, সেই রুটে কোনও রোগী যাতায়াত করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট রুটের আসনপিছু ভাড়া লাগবে। কিন্তু তার বাইরে অন্য কোথাও থেকে রোগীকে তুলতে হলে পুরো হেলিকপ্টার ভাড়া করতে হবে। সাতটি আসনের হিসেবে তখন খরচ ১১-১২ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে অবশ্য দু’পিঠের ভাড়াই প্রযোজ্য হবে, কারণ কপ্টারটি কলকাতা থেকে গিয়ে রোগী নিয়ে আবার কলকাতায় ফিরবে।
অর্থাৎ কি না, সব মিলিয়ে ২২-২৪ হাজার! এত টাকা গুনে রোগীর বাড়ির লোক হেলিকপ্টার ভাড়া করবেন কেন?
পরিবহণ-সূত্রের দাবি, সঙ্কটাপন্ন পরিজনকে বাঁচানোর স্বার্থেই হেলিকপ্টারের সুবিধা নেবেন ওঁরা। “জেলা থেকে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে কলকাতায় আসতেও খরচ কিছু কম পড়ে না! উল্টে বিস্তর দেরি হয়। চিকিৎসার অতি জরুরি সময় (গোল্ডেন আওয়ার) পার হয়ে যায়। হেলিকপ্টার থাকলে সেই সময়টা তো অন্তত বাঁচবে!” মন্তব্য এক পরিবহণ-কর্তার। মন্ত্রী মদনবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, এ সব ক্ষেত্রে রোগীর উপরে আর্থিক চাপ কিছুটা কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “হাসপাতালগুলোকে বলা হয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে মাসে দু’ঘণ্টার উড়ান-সময় কিনে রাখতে। সেই টাকাটা হাসপাতালই দিক। এতে রোগীদের কিছু সুবিধা হবে।”
তাতেও অবশ্য ধন্ধ কাটছে না। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মরণাপন্ন রোগীই যদি আনা না গেল, তা হলে মানুষ এই পরিষেবায় আগ্রহী হবে কেন? দ্রুত কলকাতায় পৌঁছাতে তো সাধারণ বিমানই আছে! আর সঙ্কটজনক বা আপৎকালীন পরিস্থিতি না-থাকলে রোগী নিয়ে তো ট্রেনেও আসা যায়?
পরিবহণমন্ত্রীর যুক্তি, “সাধারণ বিমান বা ট্রেন অসুস্থ মানুষকে দার্জিলিং-ক্যানিংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তুলে কলকাতায় আনতে পারবে না। হেলিকপ্টার পারবে। আর তার ভাড়াও অনেক ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলান্সের চেয়ে কম পড়বে।” মদনবাবু জানাচ্ছেন, রোগীবাহক কপ্টার কলকাতায় এসে নামবে বিমানবন্দর, বেহালা ফ্লাইং ক্লাব কিংবা রেসকোর্সে। সেখান থেকে রোগীকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছে দেবে অ্যাম্বুল্যান্স। মন্ত্রী এ-ও জানিয়েছেন, অ্যাম্বুল্যান্সের খরচটুকুতে ছাড় দেওয়ার জন্যও সরকার হাসপাতালগুলিকে অনুরোধ করবে।
উদ্যোগটিকে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষেরা কী ভাবে দেখছেন?
তাঁদের মতে, এটি যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ। আলিপুরের এক হাসপাতালের প্রধান রূপক বরুয়া, বাইপাসের একটি হাসপাতালের কর্ণধার সরাজব্রত পুরকায়স্থ, দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালের কর্তা সত্যজিৎ বসু কিংবা বাইপাসের আর এক হাসপাতালের প্রধান তাপস মুখোপাধ্যায় সকলেরই আশা, দূর-দূরান্তের রোগীরা এতে নিঃসন্দেহে উপকৃত হবেন। “উত্তরবঙ্গ-সহ দূরের বহু জেলা, এমনকী উত্তর-পূর্ব ভারত, ঝাড়খণ্ড, বিহার, সিকিম থেকে আমাদের কাছে বহু রোগী আসেন। ওঁদের অনেকেই যথেষ্ট সম্পন্ন। তাঁরা তো হাতে চাঁদ পাবেন!” বলছেন কলকাতার এক হাসপাতাল-কর্তা।
পরিষেবা কি শুধু বেসরকারি হাসপাতালেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
এ ব্যাপারটাও সরকারের মাথায় রয়েছে। কলকাতার সরকারি হাসপাতালে দেখাতে উৎসুক রোগীরাও যাতে কপ্টারের সুবিধা পেতে পারেন, সে জন্য দিন সাতেক আগে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে চিঠি দিয়েছে পরিবহণ দফতর। পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “সরকারের থেকে যখন কম ভাড়ায় হেলিকপ্টার-পরিষেবা মিলছে, তখন অনেক রোগীই চাইবেন তার মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে এসে চিকিৎসা করাতে।” তেমন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েই স্বাস্থ্য দফতরকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মদনবাবু। স্বাস্থ্য দফতরের কী বক্তব্য?
স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে পরিবহণের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, “নীতিগত ভাবে এতে আমাদের আপত্তি নেই।” |