প্রবন্ধ ২...
দক্ষিণ আফ্রিকায় এক ভারতীয় সন্ন্যাসী
স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় বসেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের সমস্যার কথা প্রথম জানতে পেরেছিলেন। এক ভারতীয় ব্যবসায়ী ভারতীয় উদ্বাস্তুদের ধর্মীয় বিষয়ে অবগত করানোর জন্য উপযুক্ত কাউকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাঠাতে স্বামীজিকে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু সহায়সম্বলহীন এই সন্ন্যাসীর হাতের কাছে এমন কোনও লোক তখন ছিলেন না, যিনি তাঁকে সাহায্য করতে পারেন। এর কয়েক দশক পরে স্বামীজির ইচ্ছার কথা ভেবেই ১৯৩৪ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীশ্রী সারদা দেবীর শিষ্য স্বামী আদ্যানন্দ দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিলেন।
এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকান ভারতীয় এক যুবক ধনগোপাল নাইডু স্বামীজির বাণীর দ্বারা উদ্দীপ্ত হন ও একটি যুবক দল গঠন করে নিয়মিত রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ও বেদান্ত সাহিত্যের পাঠ আলোচনা ও অনুশীলন শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে, ১৯৪২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ কেন্দ্র শুরু হয়। এক দিকে বিবেকানন্দের আত্মজাগানিয়া বাণী এবং অন্য দিকে সাংস্কৃতিক চেতনা এই যুবকদের কেবলমাত্র ভারতীয়দের কথা ভাবতেই শেখায়নি, বরং ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’-এর আদর্শে দক্ষিণ আফ্রিকানদের সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
১৯৪৬ সালে ডারবানে এক বিরাট শ্রমিক ধর্মঘট হয়। বিবেকানন্দের ভাবনা ধনগোপাল নাইডুকে কখন যে নিঃশব্দে বদলে দিয়েছে, সেটা প্রকাশ পায় এই বন্ধে। এই অভিনব অভিযানে একটি শাখার নেতৃত্ব দিয়ে ধনগোপাল গ্রেফতার হন। তাঁর উপর চলে পুলিশের অকথ্য অত্যাচার। ধনগোপাল এর পরেও দু’বার কারাবরণ করেন। ডারবানের এই অভিযান দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ধনগোপাল ভারতে এসে সন্ন্যাস গ্রহণ করে নতুন নামে পরিচিত হন: স্বামী নিশ্চলানন্দ। কিন্তু সঙ্ঘের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দ তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরে যেতে বলেন।
১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ডারবানের হারবারে যখন জাহাজ থেকে নামলেন, তখন ১০০ জন মতো বন্ধু ও শুভার্থী তাঁকে সংবর্ধনা জানান। শ্রীশ্রী সারদা মায়ের শতবার্ষিকী উৎসবের সময় স্বামী নিশ্চলানন্দ ডারবান এবং অন্যান্য শহরেও উৎসবের আয়োজন করেন। ১৯৫৩’র ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ডারবানের অনুষ্ঠানে হাজারেরও বেশি মানুষ রোজ যোগ দেন। এই ঘটনা রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের প্রতি মানুষের অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। এক দিকে তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, অন্য দিকে চমৎকার ভাবে আপন করে নিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের। আর্শ্চযের বিষয়, খুব অল্প সংখ্যক, কিন্তু সমাজে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু সাদা চামড়ার মানুষের দল এই ভাবপ্রভাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামী নিশ্চলানন্দ ধ্যানের ক্লাস নিয়ে, বই প্রকাশ করে, বক্তৃতা দিয়ে, শিক্ষা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বামীজির ব্যবহারিক বেদান্তকে কাজে লাগিয়ে অক্লান্ত ভাবে কাজ করেছেন। তিনি তাঁর কাজের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন দক্ষিণ-উত্তর রোডেশিয়াতেও।
১৯৫৯ সালে এই ভাবান্দোলনের একটি স্থায়ী ঠিকানা হয় ডারবানে। আশ্চর্যের বিষয়, দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও শিক্ষিত কিছু সাদা চামড়ার মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারার অনুরাগী হয়ে ওঠেন। স্বভাবতই দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কাছে এটা বেশ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাদের পরিজনরা এই কেন্দ্র থেকে আধ্যাত্মিক চেতনায় দীক্ষিত হওয়ায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবের প্রচার ও প্রসার ওই দেশের সরকারের চোখের বালি হয়ে ওঠে। ১৯৬১ সাল থেকে এই কেন্দ্রের উপর কড়া নজরদারিও শুরু হয়। আশ্রমে ক্রমাগত অতর্কিত আক্রমণ চলত।
বিদেশিদের কাছে পাওয়া অত্যাচার, অপমান, বৈষম্য যন্ত্রণা, এ সব যেন দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের মানুষকে অনেক কাছে এনে দিয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবান্দোলনের আঁচ পেয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলাও। তাঁর নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে স্বামী নিশ্চলানন্দের ভূমিকাকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেবল ভারতীয় বংশোদ্ভবদের খুশি করতেই তিনি এ কথা বলেননি। রবেন আইল্যান্ডে যে কয়েক জন বন্দির সঙ্গে ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের অনেকেই স্বামী নিশ্চলানন্দের সংস্পর্শে এসে বিবেকানন্দ ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন, তাঁদের কাছেই নেলসন জানতে পেরেছিলেন স্বামী নিশ্চলানন্দের অস্বাভাবিক মত্যুর কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই বলেন যে, দেশ স্বাধীন করার কাজে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন বলেই ডারবান কেন্দ্রের কাছে এক গুহায় তিনি যখন নিভৃতে ধ্যানরত ছিলেন, সেই সময় বর্ণবৈষম্যবাদী নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তাঁকে হত্যা করে। ম্যান্ডেলা মুক্তি পাওয়ার পর দেশের নানান জনগোষ্ঠী ও জনজাতিদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সমন্বয়সাধনের দায়িত্ব যাঁদের উপর দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন স্বামী নিশ্চলানন্দের ঘনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী। ম্যান্ডেলার ঐকান্তিক ইচ্ছায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সহযোগী হিসেবে বেশ কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ দেশ ও সরকার গঠনে যোগদান করেন এবং তাঁদের অনেকেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। দেশের উন্নতিতে ‘কাউন্সিল অব রিলিজিয়াস লিডার্স’ গঠন করার উদ্দেশ্যে ম্যান্ডেলা রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী সারদাপ্রভানন্দকে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানান। রামকৃষ্ণ মিশনকে সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলির স্থায়ী সদস্য হিসেবেও গ্রহণ করেন। ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ও রামকৃষ্ণ মিশনের ঐকান্তিক উদ্যমে সে দেশের সংবিধান স্বীকৃত ভাষাগুলির মধ্যে সংস্কৃত-সহ হিন্দি, তেলুগু, তামিল ও গুজরাতি নিজেদের জায়গা করে নেয়। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত ইচ্ছাতেই ‘ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশনাল সার্ভিসেস’ ও ‘ডিপার্টমেন্ট অব সেফটি অ্যান্ড সিকিয়োরিটি অব দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা’-র বেশ কিছু ক্ষেত্রে উপদেশনার দায়িত্বে আছে রামকৃষ্ণ মিশন।
মানুষের সঙ্গে মানুষের এক কৃত্রিম ভেদরেখা দিয়ে আঁকা সমাজের একটা ছবি দৈনন্দিন জীবনে ফুটে ওঠে। সাদা-কালো ও জাতপাতের নামে মানুষের অমর্যাদার সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসে। শ্রীরামকৃষ্ণের দান দু’টি মহামন্ত্র ‘যত মত তত পথ’ ও ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’— সেই কৃত্রিম ভেদরেখা মুছে দিয়ে মানুষকে কেবল মানুষের মর্যাদা দান করে তাই নয়, বরং মানুষকে দেবত্ব দান করে। শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা মনুষত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত হবার ভারতীয় পরম্পরার এক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এই কারণেই দেশে-বিদেশে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার প্রতি মানুষের আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের মতো নেলসন ম্যান্ডেলার প্রাণের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকেও বিবেকানন্দের বাণী জাগিয়ে তুলেছে ও তুলবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.