‘স্থাপত্যে সঙ্কট’ (৪-১) শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য প্রবীর মালাকার ধন্যবাদার্হ। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাঙরা-অলংকৃত নহবৎখানা, চকমিনার, টেরাকোটা-শোভিত পূজামণ্ডপ ও নাটমন্দির যথাথর্র্ অর্থেই ঐতিহ্যের এক একটি কীর্তিস্তম্ভ। কিন্তু বর্তমানে এগুলি অনাদরে, অবহেলায় ভগ্নোন্মুখ। এ বিষয়ে বহু লেখালেখিও হয়েছে।
আমি কৃষ্ণনগরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। গত বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় আমরা কয়েক জন রাজবাড়ির বর্তমান স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে দেখা করে নহবৎখানার সংস্কার সংরক্ষণ এবং হেরিটেজ ঘোষণা প্রসঙ্গে আলোচনা করি। |
রাজবাড়ির বর্তমান মালিক মুক্তকণ্ঠে বলেন যে তিনি ‘বেসিক্যালি অ্যান্টি-হেরিটেজ’, ঐতিহ্য বিরোধী। এ বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়েও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তিনি তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এগুলি আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি। আমরা নিজেরাই মেরামত করব। আপনারা বরং কলকাতা-কৃষ্ণনগর বিধ্বস্ত ৩৪ নং জাতীয় সড়ক মেরামতের জন্য আন্দোলন করুন।’ তিনি অবশ্য এই সঙ্গে অগ্রিম আশ্বাস দেন যে, তাঁরা নিজেরাই শীঘ্র নহবৎখানা মেরামতের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এই আশা বুকে নিয়েই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। |
গৌতম চক্রবর্তী তাঁর ‘হুঙ্কার তুমি কোথা হইতে’ (৩-১১) রচনায় বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হুঙ্কার চর্চার কথা বলেছেন। তবে, বৈদিকযুগে তপোবনবাসী মুনি-ঋষিরাই কেবল হুঙ্কার উচ্চারণ করতেন না। বৈদিক সমাজজীবনে যজ্ঞক্রিয়ার মতো হুঙ্কার উপাসনাও নিত্যক্রিয়া ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে।
উপনিষদের ধারণায় যা কিছু সাধু বা মঙ্গলময় তাই সাম, পৃথিবী থেকে আরম্ভ করে ঊর্ধ্বদৃষ্টিতে এবং ঊর্ধ্বদৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে নিম্নদৃষ্টিতে বা জাগতিক স্তরে অবতরণ হল সামোপাসনা। সেখানে সামকে প্রথমে পাঁচপ্রকারে পঞ্চলোকের সঙ্গে, পরে বৃষ্টি প্রভৃতি পঞ্চভৌতিক ক্রিয়া, পঞ্চঋতু, পঞ্চপশু, পঞ্চেন্দ্রিয়ের সঙ্গে একতা স্থাপনের কল্পনা করা হয়েছে— যেখানে পৃথিবী, দ্যুলোক, বৃষ্টির পূর্বের বাতাস বা পুরোবাত, বৃষ্টিধারা, বসন্তঋতু, ছাগপশু এবং প্রাণকে হিঙ্কার বলা হয়েছে।
পরে আবার বাক্যের সপ্তবিভাগে সপ্তপ্রকার সামের উপাসনায় আছে— যৎ কিঞ্চ বাচো হুমিতি স হিঙ্কারো...অর্থাৎ হুম্ অক্ষরযুক্ত সমস্ত বাক্যই হিঙ্কার। তাই হিঙ্কার ও হুঙ্কার পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এ ছাড়া প্রাণকে যখন হিঙ্কার রূপে চিন্তা করা হচ্ছে মন তখন নিধনরূপী, আবার মন যখন হিঙ্কাররূপ প্রাণ তখন নিধনরূপী। সীতানাথ তত্ত্বভূষণের মতে, ‘বাথিক অনুষ্ঠান প্রধান ধর্ম হইতে ধ্যানপ্রধান ধর্মজাতীয় ক্রমোন্নতির ইতিহাস বুঝিবার পক্ষে ইহাদের উপযোগিতা আছে সন্দেহ নাই।’ ছান্দোগ্য উপনিষদকার ঋষি তাণ্ড্যের ভাবনায় হিঙ্কাররূপ সামোপাসনা বৃত্তাকারধর্মী পূর্ণতার প্রতীক। তাই কৃষ্ণাবতার চৈতন্য মহাপ্রভু হুঙ্কার উচ্চারণ করা মাত্রই শ্রীমতীর ন্যায় হিঙ্কাররূপী বিরাটের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন এবং তুরীয়ানন্দে নৃত্য করতেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘নাচে প্রভু হুঙ্কার গর্জন’ দ্বারা এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন।
হুম্ অক্ষরযুক্ত হিঙ্কাররূপী সামোপাসনা সে যুগে শুধুমাত্র উচ্চদার্শনিক বা আধ্যাত্মিক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নারীপুরুষের দৈহিক মিলনের মতো জৈব ধর্মেও (বৈদিকযুগে এটি পবিত্র কর্ম হিসাবে গণ্য হত) সামোপাসনার প্রয়োগ ঘটেছে। হিঙ্কার কিন্তু শয়নগৃহের ধ্বনি নয়। ছান্দোগ্য জানাচ্ছে, পুরুষ স্ত্রীকে যে ভাষায় আহ্বান করে তাই হিঙ্কার; উপমন্ত্রয়তে স হিঙ্কারো, স্ত্রীর সন্তুষ্টি বিধানকে প্রস্তাব এবং স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় গমনকে উদ্গীথ বলা হয়েছে। তাই শয়নগৃহের সাম (নিছক ধ্বনি নয়) উদ্গীথ। এই উদ্গীথ সামের পর মিথুন ভাবে কাল অতিবাহিত করার সাম নিধন। মিথুনরূপী সামের নাম বামদেব্য—বামদেব্যং মিথুনে প্রোতম্। উপনিষদকারের কাছে তাই হিঙ্কার ও হুঙ্কারে কোনও তফাত নেই। এটিই ‘হিন্দু’ ঐতিহ্য— যেখানে সবই ঈশ্বরের বসবাসের যোগ্য, সবই মধুময়— মধুমৎ পার্থিবং রজঃ। পার্থক্য শুধুমাত্র প্রয়োগবিধিতে। |