রাজনীতির পরিসরে সরাসরি প্রবেশ করেছে উপমধ্যশ্রেণি। এই শ্রেণি গজকচ্ছপ আকারের,
মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায়, চিনে রাখা সম্ভবই নয়। এই উপশ্রেণি অনবরত ভাঙতে
থাকে ও জোড়া লাগতে থাকে। শ্যাওলার মতো।
দেবেশ রায় |
নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতা সংস্করণে প্রথম সম্পাদকীয়তে ছিল না নববর্ষ নিয়ে কোনও পরিচিত কথাবার্তারই সময়োপযোগী উপস্থাপন। বরং ছিল নতুন বছরের সবচেয়ে চমকে দেওয়া রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাখ্যা। দিল্লিতে ‘আপ’-এর সরকার তৈরি করা ও সেই সরকারের প্রথম কাজগুলি। সম্পাদকীয়টির শিরোনামে ‘আপ’-এর মৌলিক নবীনতা নিয়ে একটু চাপা শ্লেষও ছিল, ‘চেনা পথের পথিক’।
সম্পাদকীয়ের অনতিক্রম্য আয়তনের মধ্যেও এই লেখাটিতে দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অভিমুখিতা নিয়ে কিছু ভাববার কথার সংকেত জুটল। এর দু’দিন পরই, ৩ জানুয়ারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেড় ঘণ্টার সাংবাদিক সম্মিলনেও দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দিঙ্নিরূপণই প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল। ঠিক এই ক’টি দিনের মধ্যেই মধ্যমগ্রামের এক কিশোরীর মৃত্যুপরবর্তী ঘটনা নিয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে একটা সামাজিক আলোড়ন ঘটে ও মৃতদেহের ওপর অধিকার, সৎকারের রীতিসম্মত ও আইনি অধিকারী নিয়ে আন্তঃরাজ্য রাজনীতিতে জটিলতা তৈরি হয়। এই তিনটি ঘটনার ভিতর সংযোগের কাল্পনিক সম্ভাব্য সূত্রটি কিন্তু ওই সম্পাদকীয়টিতেই ছিল। ‘আম আদমি পার্টি’ ভোটে জিতে ও কংগ্রেস-সমর্থনে সরকার তৈরি করে তাঁদের নির্বাচনী কর্মসূচি-র প্রথম ও প্রধান বিষয়টিকে কার্যকর করেছেন। ফ্ল্যাট পিছু ৬৬০ লিটার জল বিনামূল্যে ও সামান্য বেশি ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ কম মূল্যে দেওয়ার নির্দেশ বেরিয়েছে। ওই সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়েছিল, যাঁদের জন্য জলসত্র তাঁদের ‘নির্বিকল্প ভরসা রাস্তার বারোয়ারি কল’, আর যাঁদের জন্য বিদ্যুতের খয়রাতি তাঁরাও ‘চোরাপথে বিদ্যুতের সংযোগ’ ভোগ করে থাকেন। তা হলে এই ফ্রি-জল, হাফ ফ্রি-বিদ্যুতে কাদের উপকার হল? সম্পাদকীয়টিতে সাহস করে এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘মধ্যবিত্ত। ভারতের চিরসুবিধাভোগী শ্রেণি।’ |
একটি প্রধান কাগজ সম্পাদকীয়তে যে এতটা স্পষ্ট করে আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতির নতুন সুবিধালোভী ও সুবিধাভোগীদের চিনিয়ে দিতে চান, সেটি বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি স্বাস্থ্যবান লক্ষণ। যাঁরা শ্রেণিসম্পর্ক নিয়ে চর্চা করেন সেই বামপন্থী দলগুলির মুখপত্রেও শ্রেণি-নির্ণয় ও শ্রেণিগুলির অদলবদল নিয়ে আলাপ-আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না। অথচ এর বিপরীতে, উন্নয়ন, দুর্নীতি এই সব নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মুন্ডুপাত জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতির নিত্যকর্ম। পরপর দুই বার একই ধর্ষকদের দ্বারা ধর্ষিতা এক কিশোরীর হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদ নাকি এই রাজ্যের বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যাহত করার কর্মসূচি— এমন কথা বলেছেন বর্তমান রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী ও শাসক দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক!
এই যে উপমধ্যশ্রেণির কথা ১ জানুয়ারির আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে তোলা হল ও আমরা সেই কথাটিকে একটু নির্দিষ্ট করে বুঝতে চাইছি, সেই শ্রেণিটিকে কি আর একটু স্পষ্ট করে চিনে নেওয়া যায়? না, যায় না। এই শ্রেণি গজকচ্ছপ আকারের, মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায়, চিনে রাখা সম্ভবই নয়। এই উপশ্রেণি অনবরত ভাঙতে থাকে ও জোড়া লাগতে থাকে। শ্যাওলার মতো। শ্যাওলার নিজের অস্তিত্বের দরকারেই পুকুরটাকে মজা প্রমাণ করতে হয়। ‘আপ’ ঘোষণা করে সরকারি বাংলো নেবে না, গাড়ি নেবে না। এক দিন মেট্রোতে গিয়েই পর দিন ‘আপ’-এর মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা দামি গাড়িতে যাতায়াত করেন। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী সাদা তাঁতের শাড়ি ও হাওয়াই স্যান্ডেল পরেন। আর তাঁর নতুন নিযুক্ত ১৩ জন পরিষদীয় সচিব নতুন মূল্যবান গাড়ি চড়েন। কিন্তু চড়ে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। তাঁদের অনেকেরই অফিস বা দফতর নেই।
রাজস্থানের বা মধ্যপ্রদেশের বা মিজোরামের বা ছত্তীসগঢ়ের ভোটে সেখানকার রাজনৈতিক অভ্যাসই কাজ করেছে। কোথাওই এমন কোনও বদল ঘটেনি যা থেকে পাঁচ মাস পরের লোকসভা ভোটের ফলাফল আন্দাজ করা যেতে পারে। দিল্লিতেও ঘটেনি। দিল্লি বরাবরই কংগ্রেস-বিরোধী ও বিজেপি। দিল্লি পুর-নিগমের ভোটের ফল বছরের পর বছর দেখলে ভোটারদের রাজনৈতিক পছন্দের ছক পাওয়া যায়। ৭০টি বিধানসভা আসনেও যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে না তারা পাঁচ মাসে লোকসভার নেতৃস্থানীয় দল হবে? কংস বধের জন্যেও শ্রীকৃষ্ণকেও দীর্ঘতর শিক্ষানবিশি করতে হয়েছিল। মনমোহন সিংহ তাঁর শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে দুর্নীতি, দুর্বলতা, নীরবতা— এ সব রটনামাত্র। রাজনীতির ভিতটাকেই বদলে দেওয়ার চোরা কৌশল। সেই কৌশলটাই ধরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে আলোচ্য সম্পাদকীয়টিতেও— ‘মধ্যবিত্তের যতটুকু প্রয়োজন তাহা মিটাইবার যোগ্যতা ও সম্পদ তাঁহাদেরই আছে। তাঁহাদের লোভ পূরণ করিবার দায় সরকারের নহে।’ মানে, কোনও সরকারেরই নয়। এই সাহসী কথাটিকে একটু বাড়িয়ে নেওয়ার যুক্তিসঙ্গত অবকাশ আছে। ইউপিএ-২ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলির একটা বড় কারণ কিন্তু এই নিত্য পরিবর্তমান মধ্যশ্রেণির নিত্যিনতুন লোভ মেটাতে ইউপিএ-২ সরকারের অনিবার্য অক্ষমতা। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাও এইখানে।
মনমোহন সিংহের অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচিকে অনেকেই মনে করেন শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকারকই। রাজনীতিকে জুয়া খেলার নিয়মে অনিশ্চিত ফাটকা অর্থনৈতিক লাভের প্রক্রিয়া বানিয়ে ফেলে স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। সেই মতপার্থক্য স্থগিত রাখলে এই তথ্যটুকু অস্বীকারের তো কোনও উপায় নেই যে মনমোহন সিংহ-র নেতৃত্বে আমাদের দেশের উন্নয়ন ঘটেছে দ্রুততম গতিতে। অর্থনীতিতে সাংগঠনিক বদল ঘটেছে, দারিদ্র নিশ্চিত কমেছে। কৃষির সঙ্গেই অগত্যা জড়িত জনসংখ্যার অনুপাত ৫০ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির কোনও দিনই এতটা স্বাস্থ্যবান চলৎশক্তি ছিল না যা গত বছর দশ-পনেরোতে ঘটেছে। গ্রামের মানব সম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত ভাবেই গ্রামের অর্থনীতির উন্নতির ফলেই ঘটেছে। জনজীবনের প্রধান ধারা থেকে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ক্রমিক বিচ্ছিন্নতার বিপদ অনেকটা আটকানো হয়েছে এই সময়ের ভেতর। ভারতের যে টেলিকম বিনিয়োগকে আন্তর্জাতিক নিরিখেও বিস্ময়কর বলা যায়, সেটা উল্লিখিত হয় মাত্র আর্থিক কেলেংকারির উদাহরণ হিসেবে। প্রকাশ্য নিলামের ডাকে কয়লাখনির বরাত দেওয়ার সরকারি প্রস্তাব বাম আর বিজেপি-র বিরল মতৈক্যে বার বার ঠেকে গেছে। এই কথাগুলো বলার অর্থ কখনওই এটা নয় যে, ইউপিএ-২ সরকারের ব্যর্থতার লিস্টি দীর্ঘতর নয়। সেই দীর্ঘতর লিস্টি এই হ্রস্বতর সাফল্যকে নাকচ করে না। বরং প্রাধান্য দেয়।
এই অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে পরিচিত মধ্যশ্রেণির বদল ঘটেছে এক অকল্পনীয় গতিতে। তার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ। বামফ্রন্টের এমন হারের নানা কারণ আছে এবং সে সব কারণই হয়তো অংশত সত্য। এতটাই দারুণ সত্য যে ৩৪ বছরের অপ্রতিহত বামপন্থী দলগুলির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও পুর-নির্বাচনে হয় মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন অথবা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। কোনও সামাজিক বা ব্যক্তিগত প্রতিরোধও দেখা যাচ্ছে না, যদিও সংগঠিত প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু। সামান্য হলেও কিছু কিছু।
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল, বা সরকার, বা একমাত্র নেত্রী, এই নতুন উপমধ্যশ্রেণির তুষ্টির জন্য সমস্ত প্রশাসনকে, বিচারব্যবস্থা-সহ একেবারে অকেজো করে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী এত জেলা সফর করেননি। এর ফলে জেলা প্রশাসন ও সেই জেলার সঙ্গে যুক্ত রাজ্যের পরিকল্পনায় তৎপরতা ও গতি আসার কথা। তা কেন আসে না? এই সফরগুলির সঙ্গে জনসভাও আয়োজিত হয়। সেগুলো সরকারি জনসভা। সে সব জনসভায় চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি, এঁরা নানা বিষয়ে কথা বলেন। তাতে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয় যে প্রশাসনকেও মানুষজনের সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত দিতে হয়। অথচ আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় (ব্রিটিশদের তৈরি) প্রশাসনের কৈফিয়ত চাইবেন নির্বাচিত মন্ত্রী। এমন একটি বিপজ্জনক খাদ তৈরি হয়েছে যে প্রশাসক কৈফিয়ত দেন একমাত্র জনসভায়। আর জনসভা মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর অন্য কোনও মন্ত্রী তো ডাকেন না। প্রশাসনের গতি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়েছে এমন যে এক জন আইপিএস অফিসার, এক জন আইএএস অফিসারকে গ্রেফতার করে হাজতে পুরতে পারেন ও এক জন মুখ্যসচিবকে মিডিয়া মারফত জানাতে হয়, কাজটি ঠিক হয়নি। তার পর সেই আইপিএস অফিসারকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে হয়।
মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে একাধিক প্রশাসনিক সম্মেলন ও জনসভা করা সত্ত্বেও জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ নিয়ে এতটা কেলেংকারি তাঁর কানেই পৌঁছল না। এমনটা ঘটেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উন্নয়নের ও কর্মসূচির ধারণা ও সংগঠনকে কেন্দ্র করে। সেই সংগঠনকে কেন্দ্র করে এই সুবিধালোভী ও সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণি তাদের জাল বহু দূর পর্যন্ত বিস্তারিত করতে পেরেছে বলে। মধ্যমগ্রামের কিশোরীটি কী ভাবে ধর্ষিত হয়েছিলেন, স্থানীয় থানা থেকে অভিযোগ দায়ের করে ফেরার পথে দ্বিতীয় বার, আড়াই নম্বরে চলে আসার পর তাঁকে কী ভাবে এই ধর্ষকরা ঘিরে ফেলে শেষ পর্যন্ত তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে কার্যত হত্যা করে, তার এক সাংবাদিক বিবরণ বেরিয়েছে আলোচিত এই সময়ের মধ্যেই, ‘দি টেলিগ্রাফ’ কাগজে। ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে ঘটনার পুনর্নিমাণে এই রিপোর্টটি অতুলনীয়। এই রিপোর্টটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে— এই ধর্ষকরা ফৌজদারি আইনের সূক্ষ্ম ফাঁকফোকর রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের চাইতে ভাল জানে। দুই থানার দুই পুলিশ বাহিনী জানে না— কোন বাহিনী মৃতদেহ নিয়ে কী করছে। যে সরকারের এটুকু সংহতি নেই, সেই সরকারের মুখে মানায় যে বিহার পুলিশের প্রতিনিধি এ রাজ্যে এসে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভব্যতা ভেঙেছেন? সেয়ানা, লোভী, কৌশলী, সুযোগলোভী, সুবিধাভোগী উপমধ্যশ্রেণি এই রাজ্যে সামাজিক ভিত্তি পাচ্ছে। যতটা দেখা যাচ্ছে, বিপদ তার চাইতেও অনেক বেশি। |