অসম পুনরায় জনজাতীয় বিদ্বেষ ও দাঙ্গার কবলে। এ বার ঘটনাস্থল অসম-নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী কার্বিআঙলঙ। এই স্বশাসিত পার্বত্য পরিষদের এলাকায় যেমন কার্বি জনজাতির বাস, তেমনই কিছুসংখ্যক নাগা, ডিমাসা, কুকি, নেপালি এবং আদিবাসীও দীর্ঘ কাল ধরিয়া রহিয়াছেন। নাগা বলিতে রেংমা নাগাদের বুঝায়, আর কার্বি জনজাতির জঙ্গি অংশটি ‘পিপল্স লিবারেশন টাইগার্স’ সংগঠনের ছত্রছায়ায় সমাবেশিত। কাহারা আগে হামলা করিয়াছে, কাহারাই বা প্রত্যুত্তরে জবাবি হামলা, সেই তর্কের মীমাংসা দুরূহ। উভয় পক্ষই জমির দখলকে কেন্দ্র করিয়া পরস্পরের প্রতি খড়্গহস্ত হইয়া ওঠে। সব মিলাইয়া কুড়ি জন জনজাতীয় নিহত এবং সন্ত্রস্ত চার হাজার মানুষ ত্রাণ-শিবিরের অস্থায়ী ছাউনির তলায় আশ্রয়প্রার্থী। উপদ্রুত এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী প্রেরিত হইয়াছে, সান্ধ্য আইনও জারি হইয়াছে। উত্তেজনা তবু সম্পূর্ণ প্রশমিত নয়।
দাঙ্গা দমনে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়টি নজর এড়াইবার নয়। দুই জনজাতির মধ্যে বর্ধমান অসহিষ্ণুতার কোনও আভাস তো পুলিশ বা গোয়েন্দাদের কাছে ছিলই না। উপরন্তু হিংসা শুরু হওয়ার পরেও দীর্ঘ পনেরো দিন ধরিয়া উত্তেজনাপ্রবণ কার্বিআঙলঙে হানাহানি চলিতে দেওয়া হইয়াছে। হিংসা ও হানাহানির শুরুতেই প্রশাসন যদি কঠোর হস্তে তাহা দমন করিতে উদ্যত হইত, সেনাবাহিনীকে দিয়া উপদ্রুত এলাকায় ফ্ল্যাগ-মার্চ করাইয়া দাঙ্গাকারীদের মনে ভয় এবং সাধারণ মানুষের মনে ভরসার সঞ্চার করা যাইত, তবে নিঃসংশয়ে এতগুলি মূল্যবান প্রাণ রক্ষা সম্ভব হইত। কিন্তু ভারতে সাম্প্রদায়িক কিংবা জাতিগত দাঙ্গা মোকাবিলার চিরাচরিত পদ্ধতিই হইল, কিছু কাল হিংসার আগুন জ্বলিতে দেওয়া। হয়তো দাঙ্গায় নিহিত অবরুদ্ধ বিদ্বেষের বিষবাষ্প কিছুটা বাহির করিয়া দিবার লক্ষ্যেই এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। দায়বদ্ধ, কল্যাণব্রতী কোনও রাষ্ট্র কিন্তু প্রজাহিতের এহেন পদ্ধতি অবলম্বন করিতে পারে না। জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেওয়া যে কোনও রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীদের কড়া হাতে দাঙ্গা মোকাবিলার নির্দেশ না দিলে তাহারা স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া হিংসা দমনে তৎপর হইবে না। এ ক্ষেত্রে অসম সরকার স্পষ্টতই কর্তব্যের খেলাপ করিয়াছে।
অসম তথা সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলেরই জনজাতীয় বিন্যাসের জটিলতা অবশ্য সীমাহীন। এত অগণিত জনজাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠী ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা ও সংলগ্ন পার্বত্য মালভূমিতে আসিয়া বসবাস করিয়াছে যে, কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভূমিপুত্র ঠিক কাহারা, অঞ্চলের বাস্তুজমি, কৃষিজমি, নদী-জল ও অরণ্য-বৃক্ষের উপর কাহার অধিকার সর্বাধিক, সেই প্রশ্নে কাজিয়া অন্তহীন। ইহার মধ্যেই কিছু জনজাতি নিজেদের স্বতন্ত্র রাজ্য হাসিল করিয়া লইয়াছে— যেমন নাগা, মিজো, মণিপুরি প্রভৃতি। অনেকে আবার দীর্ঘ আন্দোলন শেষে নিজেদের জন্য স্বশাসিত পরিষদ হাসিল করিয়া লইয়াছে, যথা— বড়ো, কার্বি, ত্রিপুরি ইত্যাদি। কিন্তু মণিপুরে যেমন নাগা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রাজ্যের আরও বিভাজন চায়, মেঘালয়ে তেমন খাসি, গারো ও জয়ন্তিয়া জনজাতি চায় আত্মপরিচয় এবং স্বশাসনের বৃত্ত প্রসারিত করিতে। এত রকম চাহিদার মধ্যে সংঘাত হইতে বাধ্য, হইতেছেও। প্রশাসনের কাজ হইল, গভীর সংবেদনশীলতার সহিত এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা। |