ভারতীয় নারী যতই তাহার শৃঙ্খল ঝাড়িয়া ফেলিয়া অগ্রসর হউক, নারীত্ব বিষয়ে ভারতীয় সমাজের ধারণা কিন্তু সমগতিতে পরিবর্তিত হইতেছে না। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অবিচ্ছিন্নতায় যেমন তাহার প্রকাশ, নারী-অপরাধমূলক অভিযোগের আশঙ্কা হু-হু করিয়া বাড়িয়া যাইবার মধ্যেও তাহা স্পষ্ট। সম্প্রতি নাকি বিচারকদের মধ্যে মহিলা ইনটার্ন লইবার বিষয়ে তীব্র অনীহা। বুঝাই যায়, এক উচ্চপদস্থ কর্তৃস্থানীয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইহা আকস্মিক প্রতিক্রিয়া-মাত্র নহে, বরং এই অস্বস্তি, আশঙ্কা ও অনীহার উৎস গভীরতর। অভিযোগের সম্ভাবনা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-মানসিক ভুবনে নারীত্ব বিষয়ে সচেতনতার তীক্ষ্ণতাও বাড়িতেছে, যাহা সম্ভবত সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সহায়ক নহে। উদাহরণ: সম্প্রতি প্রাক্তন বিচারপতির হেনস্থার প্রেক্ষিতে দেখা যাইতেছে, বিচার-পেশার ক্ষেত্রে আদৌ মহিলা ইনটার্ন লইবার পদ্ধতি বন্ধ করা যায় কি না, প্রশ্ন তত দূরও গড়াইয়াছে। এ ভাবে দুই লিঙ্গসমাজের দূরত্ব যত বাড়িবে, ‘নারীত্ব’ আরও সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হইবার সম্ভাবনা। এমনিতেই দেখা যায়, পুরুষ তাঁহার সহকর্মী নারীর ‘নারীত্ব’ বিষয়ে যত বেশি সতর্ক ও সচেতন হন, নারীও পুরুষের সমকক্ষ হইবার জন্য ‘পুরুষালি’ হইবার প্রয়োজন অনুভব করেন। তবে কি সত্যই ভারতীয় সমাজ-মননে ‘নারীত্ব’ বিষয়টি অধিকতর সংকটময় হইয়া উঠিতেছে? নারীত্বের সহিত স্বাভাবিক নিরপেক্ষ সহাবস্থানের সম্ভাবনা সুদূরতর হইতেছে?
অথচ, নারী-অধিকার ও নারী-সক্ষমতা আসিলেই নারীত্বের ধারণা আপনা-আপনি দ্রুত পাল্টাইবে, এই ছিল সাধারণ ধারণা। পশ্চিমি অভিজ্ঞতা হইতেই এই প্রত্যাশা সঞ্জাত। পশ্চিমি সমাজে এত দিন পরেও নারীত্ব-সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা যে কত প্রখর, বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকুরিস্থলের মতো গণ-প্রতিষ্ঠানে যৌন উৎপীড়ন বিষয়ে সচেতনতা কত গভীরচারী, তাহা আটকাইবার জন্য সেখানে নিয়মিত কত নজরদারি, তাহা খেয়াল করা হয় নাই। যে কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা ছাত্রী বা কর্মীর সহিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যতামূলক রীতি মানিতে হয়, এখানে তেমন কিছু ভাবাই হয় নাই। এতদ্ব্যতীত, মনে হইয়াছিল, উহারা যদি লাফে লাফে আগাইতে পারে, আমরা পারিব না কেন?
স্মর্তব্য, সামাজিক অভিযোজন সর্বদা এক পথ ধরিয়া চলে না। একটি বিশেষ অভিযোজনের জন্য এক এক সমাজে এক এক রকম সময় লাগিতে পারে। পশ্চিমে নারী-অধিকার ও নারী-মুক্তি যে ভাবে আগাইয়াছে, ভারতে সে পথ ভিন্ন হওয়াটাই প্রত্যাশিত। সামাজিক প্রত্যাশা আলাদা, পারিবারিক রীতি-বিধি আলাদা। পশ্চিমে আঠারো বৎসরোর্ধ্ব সন্তান একাকী পরিবার-সীমার বাহিরে দিননির্বাহ করে। এ দেশে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, বিশেষত কন্যা-সন্তান, পারিবারিক গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে, বিবাহ-পূর্ব কিংবা বিবাহ-পরবর্তী, দুই পরিস্থিতিতেই। ফলে কন্যার মানসিক অভিযোজন ও কন্যা সম্পর্কে পরিবার তথা সমাজের অভিযোজন, দুই-ই তদনুসারে চালিত হয়। আধুনিক শহুরে বৃত্তিজীবী সমাজেও দেখা যায়, বহু মানুষ একাকী কোনও নারীর সহিত ঠিক কোন ব্যবহারটি বিধেয়, কোনটি নহে, সে বিষয়ে সচেতন নহেন। বিপরীতে, অনেক নারীও নিরাপত্তা ও আত্মসম্মান বজায় রাখিয়া কী ভাবে পেশাগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চালনা করিতে হয়, সচেতন নহেন। ব্যতিক্রম আছেই। আছে বলিয়াই ভারতের নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণির নারীর পক্ষে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা সম্ভব। কিন্তু ব্যতিক্রম-ই পরিস্থিতির প্রধান পরিচায়ক নহে। সামগ্রিক ভাবে পেশাগত ক্ষেত্রে মহিলা কর্মী, সহকর্মী, ছাত্রী, প্রশিক্ষণার্থীর সহিত সম্পর্ক-রচনার শিল্পে ভারতীয় সমাজ এখনও প্রারম্ভিক পর্বেই আটকাইয়া আছে, নাকানিচোবানি খাইতেছে। |