দু’দিনের মধ্যে বদলে গেল সিদ্ধান্তটা। শেষ পর্যন্ত বন্ধই হয়ে গেল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বহু আলোচিত জনতা দরবার।
গত শনিবার তাঁর সরকারের প্রথম জনতা দরবার বাতিল হয়েছিল জনতার প্রবল ভিড়ে। ওই অব্যবস্থার পরে উপস্থিত জনতার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ভাবে জনতা দরবার করার আশ্বাস দিয়েছিলেন অরবিন্দ।
কিন্তু সেই অবস্থানটাই বদলে গেল আজ! দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়ে দিলেন, আপাতত জনতার দরবার বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। দরবারে বসে সমস্যা শোনার চেয়ে জনতা যাতে ই-মেল, চিঠি এবং কল সেন্টারের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারেন, তার ব্যবস্থা করছে দিল্লি সরকার। তাঁর কথায়, “যাঁরা মেল করতে পারবেন না, তাঁরা কল সেন্টারে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সচিবালয়ে ড্রপ বক্স ও হেল্প ডেস্ক থাকবে। আমিও জনতার সঙ্গে দেখা করব। তার জন্য অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসার দরকার নেই।”
আরও একটি বড় সিদ্ধান্ত আজ নিয়েছেন অরবিন্দ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে দিল্লিতে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ব্যাপারে যে ছাড়পত্র দিয়েছিল পূর্বতন সরকার, আজ তা খারিজ করেছেন তিনি। এই সিদ্ধান্তে হতাশ বণিকমহল। যদিও অরবিন্দ জানিয়েছেন, তাঁরা সামগ্রিক ভাবে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির বিরোধী নন। ক্ষেত্র বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষপাতী।
আপ-সরকারের প্রথম জনতা দরবারই অন্তিম দরবারে পরিণত হওয়ায় বিজেপি খুশি। দলের মুখপাত্র নির্মলা সীতারমনের কটাক্ষ, “কেজরিওয়াল এ বার বুঝতে পারছেন, প্রশাসন চালনা করা কতটা কঠিন।”
অরবিন্দ ব্যর্থ হলেও বিহারে কিন্তু গত আট বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে জনতা দরবার চালু রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এই সাফল্যের রসায়ন কী? নীতীশের কথায়, “জনতা দরবার ৮ বছর ধরে চালাচ্ছি। ধীরে ধীরে এর পরিমার্জন করা হয়েছে। জনতা দরবারের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রথম দিকে মাসে দু’দিন হতো। এখন তিন দিন। আগে সব দফতরকে জনতা দরবারে সামিল করা হতো। এখন দফতরগুলিকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।” একই সঙ্গে নীতীশের বক্তব্য, “জনতার দরবারে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত হন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জনতা নয়। এই দরবার আমি চালিয়ে যাব। দরবার যে দিন বন্ধ হয়ে যাবে সে দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
জনতা দরবারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা প্রত্যাহার করা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে আপ-এর অন্দরে। অনেকেই বলছেন, এ ভাবে তড়িঘড়ি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। দলের একটা অংশের মতে, জনতার মুখোমুখি বসে সমস্যার কথা শোনা দলের ভাবমূর্তির পক্ষে ভাল। কিন্তু তাতে যে অসুবিধাও রয়েছে, তা-ও মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে গত শনিবারের বিশৃঙ্খলার পরে। দলের একটা বড় অংশের মতে, এ ধরনের খোলা জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যদের উপর হামলার আশঙ্কা রয়েছে বলে ইতিমধ্যেই রিপোর্ট দিয়েছেন গোয়েন্দারা। তা ছাড়া, গত শনিবার যা হয়েছিল, তাতে যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। সে ক্ষেত্রে দায়ী হতো অরবিন্দের সরকারই। আরও একটি সমস্যার দিকে দলের নজর টেনেছেন এই নেতারা। তা হল, এই ধরনের দরবারে আসা জনতার একাংশের ধারণা, তাঁদের সমস্যা জানানো মাত্রই তার সমাধান হয়ে যাবে! বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু জনতাকে সেটা বোঝানো কঠিন বলেই মনে করছেন এই নেতারা।
অনেকেই মনে করছেন, নতুন মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব ছিল, এলাম ও করে দিলাম ধাঁচের! কিন্তু বাস্তবে মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যে কতটা কঠিন, তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ অরবিন্দ। বিষয়টি আজ মেনেও নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কাজে খামতি থাকবেই। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” এ বার তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিতে চাইছেন আপ নেতৃত্ব। দলের এক নেতার কথায়, “সরকার চাইলেও এক নিমেষে যে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয় না, তা বুঝতে হবে সাধারণ মানুষকে। আর সেটা বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে দলকেই।”
বিদ্যুতে ভর্তুকি ও ঠিকা কর্মীদের চাকরি পাকা করার মতো বিষয়গুলি নিয়েই এখন চিন্তায় আপ-নেতৃত্ব। ঠিকা কর্মীদের বিষয়ে ইতিমধ্যেই এক মাস সময় চেয়ে রেখেছেন অরবিন্দ। সমস্যা রয়েছে বিদ্যুতের বিল নিয়ে। বিদ্যুতের বিলের বোঝা অর্ধেক করতে তাঁর সরকার যে দু’শো কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা এখনও বিধানসভায় পাশ হয়নি। মার্চের আগে বিধানসভার কোনও অধিবেশনও নেই। এ দিকে মার্চ মাস থেকে দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে ভর্তুকির টাকা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি বিধানসভায় পাশ হওয়া কঠিন বলেই মনে করছেন আমলারা। তবে কেজরিওয়াল যদি আগামী মাসেই বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে বিলটি পাশ করান, তা হলে অন্য কথা। কিন্তু আপের একাংশ মনে করছেন, তড়িঘড়ি না করে মেপে মেপেই পা ফেলা উচিত। একই ভাবে কমনওয়েলথ গেমস সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্ত বা জন লোকপাল বিল পাশ করানো নিয়েও ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়ার পক্ষে আপ নেতৃত্ব।
সব মিলিয়ে আর চটজলদি সমাধানের প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব মেনে ধীরে এগোনোরই পক্ষপাতী আপ নেতৃত্ব। দলের নেতাদেরও অনেকেই বলছেন, এ ভাবে জনমোহিনী সিদ্ধান্ত নেওয়া ছেড়ে সমস্যার গভীরে ঢুকে তার সমাধান করার পথে এগোলে দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে দলেরই। |