পেটের খাতিরে ওদের বাবা-মা বছরের বেশির ভাগ সময়ই গ্রামে থাকেন না। সংসারের খরচ জোগাতে বাড়ি থেকে বহু দূরে পড়ে থাকেন ইটভাটা কিংবা খেতে-খামারে। হতদরিদ্র ওই সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে দেখাশোনার জন্যও কেউ নেই। তাই কচিকাঁচাদেরও বাবা-মায়ের সঙ্গেই যাযাবরের মতো কাটাতে হয়। ফলে টানা কয়েক মাস ধরে স্কুলেই যেতে পারে না ওই ছেলেমেয়েরা। ওই ক’ মাসের জন্য মুশকিল আসান হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান ‘মিঠু দিদি’। ওরা যাতে স্কুলছুট না হয়ে পড়ে, তার জন্য বাড়ির বাইরে থাকার ক’ দিন ওই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাঠ দেন কীর্ণাহারের মিঠু পাল। বছর পঁয়ত্রিশের মিঠুদেবী লাভপুরের জামনা গ্রামের ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় পড়িয়ে চলেছেন। সাধ্যমতো বইখাতা-সহ পড়াশোর নানা সরঞ্জামও জোগাচ্ছেন।
ওই ইটভাটায় প্রায় শ’ খানেক শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছে ৩৫ জন শিশুও। অধিকাংশেরই বাড়ি মুরারই থানা এলাকায়। কিন্তু বছরের সাত মাস, নভেম্বর থেকে মে অবধি শ্রমজীবী ওই পরিবারগুলির ঠিকানা ইটভাটা। জুন মাসে একবার বাড়ি ফেরার সুযোগ মেলে। তার পর তাঁরা কাজের খোঁজে ফের পাড়ি জমান বর্ধমান কিংবা হুগলির দিকে। ওই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা কেউ এলাকার স্কুলে কেবল নামটুকুই রয়েছে। বাইরে চলে যাওয়ায় বছরের একটা বড় সময় তারা স্কুলে উপস্থিত থাকতে পারে না। ফলে ব্যাঘাত ঘটে পড়াশোনায়। স্বাভাবিক ভাবেই এমন যাযাবরের মতো জীবনযাত্রায় পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে পড়তে পড়তে অনেকেই শিশু শ্রমিকে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ওই সব ছেলেমেয়েদের মনে পড়াশোন নিয়ে উৎসাহ জাগিয়ে তুলেছে মিঠু দিদির ক্লাস। তাতে সমস্যা মিটেছে অনেকটাই। বাড়ি ফিরে এখন আর আগের মতো তারা স্কুলের পরীক্ষায় বসতে একটুও ভয় পায় না। |
শব্দ চেনাচ্ছেন কীর্ণাহারের মিঠু পাল। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি। |
ইটভাটার জমিতেই কচিকাঁচাদের নিয়ে চলছে ক্লাস। মাটিতেই ব্ল্যাকবোর্ড। সেখানে লেখা রয়েছে ‘বাবা’, ‘মামা’, ‘দাদা’ প্রভৃতি শব্দ। পড়ুয়াদের শব্দ চেনাচ্ছেন মিঠুদেবী। গত দু’ বছর ধরে এই বিনা পয়সার স্কুল চালাচ্ছেন মিঠুদেবী। ক্লাস বসে প্রতি শনি ও রবিবার। শুধু পাঠদানই নয়, কচিকাঁচাদের জন্য ঝোলা থেকে বের করে দিচ্ছেন চকোলেট, বিস্কুটও। ওই ইটভাটায় কর্মরত বাবা-মায়ের সঙ্গে জামনাতেই গত কয়েক মাস ধরে রয়েছে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া মাল। বলছে, “দিদির জন্যই ইটভাটাতে থেকেও পড়াশোনা করার অভ্যেসটা চলে যায়নি।” দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুমি কোনাই আবার বলছে, “দিদির কাছেই পড়া তৈরি করে নিই। বাড়ি ফিরে স্কুলের পরীক্ষায় বসতে তাই আর ভয় লাগে না!”
গ্রাম থেকে দূরে এই ইটভাটাতেই গত কয়েক মাস থেকে পড়ে আছেন মানিক পাল, নিভা কোনাই, মানিক মালরা। পেটের টান তাঁদের এত দূরে নিয়ে এসেছে। উপায় নেই বলে ছেলেমেয়েদেরও আনতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এখানে এসেও যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তায় পড়বেন না, তা তাঁরা ভাবেননি। কিন্তু গত দু’বছর ধরে ইটভাটার শ্রমিকদের সেই ভাবনা দূর করেছেন মিঠুদেবী। দিদিমণির প্রশংসা করে তাঁরা বলছেন, “সংসার চালাতে কাজে খোঁজে আমাদের বছরের অধিকাংশ সময়ই এলাকার বাইরে থাকতে হয়। একলা বাড়িতে তো কোনও নিরাপত্তা নেই। তাই ছেলেমেয়েদেরও সঙ্গে নিতে হয়। তাতে ওদের পড়াশোনার ক্ষতি হত।” ক্ষতির কথা বুঝতে পেরেও আর্থিক অসঙ্গতির কারণে তাঁদের এই পথ নিতে হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন। কিন্তু মিঠুদেবীর উদ্যোগের পর থেকে তাঁদের চিন্তা দূর হয়েছে। নিজেদের স্কুল থেকে দূরে এসেও তাদের পড়াশোনার মধ্যে রেখেছে মিঠু দিদির ওই ঘরোয়া ক্লাস।
এমনিতে মিঠুদেবী কীর্ণাহারে একটি বেসরকারি ইংরাজি মাধ্যম স্কুল চালান। সেখানে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি ক্লাস নেন জামনা ইটভাটার শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদেরও। মিঠুদেবী অবশ্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন বলে মনেই করেন না। সবিনয়ে বললেন, “নিজে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোর সুবাদে বুঝেছি, দেখভালের কেউ না থাকলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বেই। আর ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে পড়তেই তারা এক দিন স্কুলছুট হয়ে শিশু শ্রমিকের দলে নাম লেখাবে।” এটাই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি মিঠুদেবী। তাই উদ্যোগ নিয়ে ওই শ্রমিকদের বুঝিয়ে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
প্রশাসন সূত্রে খবর, বছর দু’য়েক আগেও ‘ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রোগ্রাম’ বিনা পারিশ্রমিকে এক ধরনের স্কুল চালাত। শুধু মাত্র স্কুলছুটদেরই জন্য ছিল ওই স্কুল। সেখানে ইটভাটার শ্রমিকদের ওই ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার একটা সুযোগ ছিল। এই জেলায় এ রকম ৫০টি স্কুলও ছিল। কিন্তু বর্তমানে ওই স্কুলগুলি বন্ধ। কারণ হিসেবে জেলা সর্ব শিক্ষা মিশনের প্রকল্প আধিকারিক অনিন্দ্য মণ্ডল বলছেন, “এখন রাজ্য সরকার স্কুলছুটদের স্কুলে ফেরাতে প্যারা টিচারদের দিয়ে একটি অভিযান শুরু করেছে। ওই শিক্ষকেরা এলাকায় এলাকায় গিয়ে স্কুলছুটদের খোঁজ করেন। যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের বাছাই করে মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া। বিনা পারিশ্রমিকেই তারা পড়ার সুযোগ পান।” এ দিকে, সরাসরি ওই পড়ুয়াদের স্কুলছুটও বলা যাচ্ছে না। কারণ, তারা ফের পুরনো স্কুলে ফিরে পরীক্ষা দেওয়া সুযোগ পায়। স্কুল থেকে দূরে থাকালেও কেউ-ই স্কুল ছাড়েনি। এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের পড়াশোনার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছেন মিঠুদেবী।
এলাকার মেয়ের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে ইটভাটার মালিক অশোক পাল বলেন, “মিঠুদেবীর জন্যই ইটভাটার শ্রমিক ছাউনিতে শিশুদের লেখাপড়া পরিবেশ চালু হয়েছে। তাঁর এই প্রচেষ্টা সচল রাখতে আমিও যথাসাধ্য সাহায্য করব।” একই আশ্বাস দিয়েছেন নানুরের তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরাও। তাঁর কথায়, “বিষয়টি আমার জানা ছিল না। তবে, এমনটা হলে শিক্ষা বিস্তারে মিঠুদেবীর ওই উদ্যোগ যথেষ্টই প্রশংসনীয়। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করব।”
আর মানিকরা বলছেন, “মিঠুদি না থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও আমাদের মতোই স্কুল ছুটে যেত!” |