কেউ হাত লাগিয়েছেন মঞ্চ বাঁধার কাজে। কেউ বাজার করতে বেরোলেন সাইকেলে চড়ে। জনা কয়েক আবার রোদ পোহাচ্ছেন নিশ্চিন্তে বসে।তাঁরা অবশ্য কেউ ডেকরেটর্সের কর্মী বা বাজার সরকার নন। তাঁরা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। উদ্বোধনের আগের দিন দুর্গাপুরে রাজ্যের দ্বিতীয় মুক্ত সংশোধনাগারে প্রস্তুতির নানা কাজে হাত লাগালেন তাঁরাও।
মুর্শিদাবাদের লালগোলার পরে দুর্গাপুরে গড়ে উঠছে এই মুক্ত সংশোধনাগার। লালগোলায় ১৯৮৭ সালে প্রায় একশো একর জায়গায় তৈরি হয় এই ধরনের জেল। কারা দফতর সূত্রে জানা যায়, সাত বছর বা তার বেশি সময় কারাদণ্ড হওয়া কয়েদিদের রাখা হয় এই সংশোধনাগারে। তাঁরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে পারেন। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাইরে বিভিন্ন কাজকর্ম করে রোজগারের সুযোগ পান। কেউ খেতে কাজ করেন, কেউ বাগান করেন, কেউ দোকান চালান। রাতে ফিরে আসেন সংশোধনাগারে। প্রতি ছ’মাসে ১৭ দিন করে ছুটি দেওয়া হয়। এ ছাড়া পরিবারে হঠাৎ কোনও বিপদ-আপদ হলে আলাদা ছুটি মেলে। |
মাঠে রোদ পোহাচ্ছেন কয়েদিরা। |
লালগোলায় প্রায় শ’খানেক কয়েদি রয়েছেন। রাজ্যের আরও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ধাপে ধাপে এই সুযোগ দিতে যায় কারা দফতর। তারই অঙ্গ হিসেবে ২০১২ সালে দুর্গাপুরে আরও একটি মুক্ত সংশোধনাগার তৈরির পরিকল্পনা হয়। মঙ্গলবার সেটির উদ্বোধন করবেন কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি।
দুর্গাপুর উপ-সংশোধনাগারের কাছে পুরনো একটি তিন তলা ভবন সংস্কার করে মুক্ত সংশোধনাগার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সোমবার সকালে গিয়ে দেখা গেল, সামনের মাঠে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ নির্মাণে ব্যস্ত কয়েকজন। তার পাশে কয়েক জন বসে রোদ পোহাচ্ছেন। মঞ্চ নির্মাণে ব্যস্ত কর্মীরা জানালেন, ওঁরা সবাই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। লালবাগ থেকে এসেছেন ১৯ জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন প্যারোলে বাড়ি গিয়েছেন।
দার্জিলিংয়ে বাড়ি সন্তোষ বিশ্বাসের। জানালেন, এক সময়ে জাহাজের রেস্তোঁরায় চাকরি করতেন। কলকাতার গড়িয়াহাটে একটি অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। যাবজ্জীবন সাজা হয়। প্রেসিডেন্সি জেলে এক জনের কাছে আলমারি তৈরির কাজ শিখেছিলেন। পরে পাঠানো হয় লালবাগে। সেখান থেকে এখন এসেছেন দুর্গাপুরে। ইতিমধ্যে একটি আলমারি কারখানায় কাজের ব্যবস্থা হয়েছে, বুধবার থেকে যোগ দেবেন বলে জানালেন তিনি। সেই কারখানায় রঙের কাজ পেয়েছেন মন্টু মাহাতো। |
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুদ্দুস আলম জানান, তিনি ২০ বছর রয়েছেন সংশোধনাগারে। রসিকতা করে বললেন, “আমিই সবচেয়ে সিনিয়র এখানে!” তিনি জানান, লালগোলায় ছিলেন সাত বছর। তাঁর আক্ষেপ, “প্রেসিডেন্সি জেল ও লালবাগ থেকে ভাল শংসাপত্র মিলেছে। অনেকে দেখি ১৪ বছর পরে ছাড়া পেয়ে যান। আমি কেন পাইনি, জানি না।” লালগোলায় চার বছর কাটিয়ে আসা পূর্বস্থলীর মদন ঘোষ আবার বললেন, “আমার ১৪ বছর হতে আর দু’মাস বাকি।”
হাওড়ার পাঁচলার মোকারম শিকারি লালগোলায় চায়ের দোকান করেছিলেন। ইঞ্জিনচালিত ভ্যানও কিনেছিলেন। সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা ছিল লালবাগে। তবে দুর্গাপুরে সে সুযোগ নেই। তবু কেন দুর্গাপুরে আসার আগ্রহ দেখালেন? মোকারম জানান, এখানে কারখানায় কাজ করবে দু’পয়সা বেশি আয় হবে। তা ছাড়া, এখান থেকে বাড়ি যাতায়াত করাও সুবিধা। তাই চলে এসেছেন।
কারা দফতরের এক আধিকারিক জানান, সাময়িক উত্তেজনার বশে কোনও অপকর্ম করে ফেলেন কেউ। কিন্তু সাজা কাটানোর সময়ে এ ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সুফল কাজে লাগিয়ে মুক্তির পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না সেই কয়েদিকে। দুর্গাপুর উপ-সংশোধনাগারের এক আধিকারিক বলেন, “আপাতত ১৯ জনকে আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারখানায় ঘুরিয়ে আনা হয়েছে তাঁদের। প্রত্যেকেরই রোজগারের ব্যবস্থার উদ্যোগ হচ্ছে।” কয়েদিরা বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বা পড়াশোনার সুযোগও পাবেন বলে জানানো হয়। শহরের একটি কারখানার কর্তা বলেন, “কয়েদিদের কাজে নিতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। ঠিক মতো কাজ করলেই আমরা খুশি।” |