‘ঠান্ডা কোথায়? সেই লোকজনই বা কোথায়?’
প্রথম বার সাগরদ্বীপে এসে এই প্রশ্নটাই চায়ের দোকানিকে ছুড়ে দিলেন হরিদ্বার থেকে আসা বলরাম স্বামী। দোকানি কিছু বলার আগেই অবশ্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ সাধুর সহাস্য মন্তব্য ‘প্রতিবার কুম্ভে যাই। এ বার কুম্ভ নেই, তাই এসেছি। কিন্তু, এখানে এমন অবস্থা...।’
আর মাত্র দু’দিন, তার পরেই আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মকর সংক্রান্তির পুণ্য স্নানে মেতে উঠবে সাগরদ্বীপ। দেশ-বিদেশ থেকে আসা হাজারো দর্শনার্থীকে বরণ করে নিতে পরিষেবায় তাই কোনও ফাঁক রাখতে চান না প্রশাসনের কর্তারা। তাই সাগরমেলার অনেক কিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। |
কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই গোটা সাগরদ্বীপ জুড়ে উঠে এসেছে একটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। যাঁদের জন্য এত কিছুর আয়োজন, তাঁরা সব গেলেনটা কোথায়? সঙ্গে অবশ্য উঠছে আর একটা প্রশ্ন, এ বার কি শীত-ও পালিয়ে গেল?
দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কথা অবশ্য আদপেই মানতে রাজি নন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কর্তারা। রবিবার রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দাবি করেছেন এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ পুর্ণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে। কিন্তু, সে কথা একেবারেই মানছেন না সাগরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় ফাঁকাই কাটাল সাগর। সাংস্কৃতিক মঞ্চের সামনেও জমল না তেমন ভিড়।
এ দিন সকালে কাকদ্বীপ থেকে কচুবেড়িয়া আসার সময়েও মেলার সেই পরিচিত ভিড় চোখে পড়েনি। কোনও জেটিতেই লম্বা লোকের লাইন নেই। এমনকী, কচুবেড়িয়া থেকে সাগরদ্বীপে আসার বাসে ওঠার জন্য তেমন হুড়োহুড়ি দেখা যায়নি। যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কোচবিহার, উত্তর ২৪ পরগনা, মালদহের বাসিন্দা যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা পুণ্যলোভীরা।
তবে এ বার কোথাও অর্ধ কিংবা পূর্ণ কুম্ভ মেলা নেই। তাই আজ, সোমবার থেকে সাগরের ভিড়টা বাড়তে পারে বলে আশা করছেন প্রশাসন থেকে বাসিন্দারা। আর সেই মতো প্রশাসনও প্রস্তুতি নিয়েছে। বড় দিনের পার্ক স্ট্রিটের মতোই বিভিন্ন রঙের এলইডি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে কপিল মুনির আশ্রম। মন্দিরের রাস্তাতেও ঝোলানো হয়েছে বাহারি আলো।
বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত জানিয়েছেন, এ বার সাগরের সব আলোই স্থায়ী। আগে রুদ্রনগর থেকে মেলায় বিদ্যুৎ আনা হত। কিন্তু কয়েক বছর আগে গ্রিড পাওয়ার নিয়ে আসায় লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ ২৭টি পয়েন্টের মাধ্যমে মেলায় আনা হয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়ে তৈরি জেলা পুলিশও। সঙ্গে রয়েছে উপকূল রক্ষী বাহিনী-সহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা। জেলাশাসক শান্তনু বসু বলেন, “হেলিকপ্টার পরিষেবাও চালু থাকছে।”
বেলা দেড়টা নাগাদ কাকদ্বীপের লট-৮’এর পাঁচ নম্বর জেটির সামনে পৌঁছে দেখা গেল বাঁশের ব্যারিকেডের ভিতরে বড়সড় জটলা। সেখান থেকেই গলা ফাটিয়ে কয়েক জন বলছেন, “টানা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে, আর কত ক্ষণ?”
ভিড় সামলানোর চেষ্টা করছেন কয়েক জন উর্দিধারী। আর সেই জটলার পাশে রাখা বড় একটা গাড়ি থেকে নেমে হাসিমুখে সবার দিকে হাত তুলে লঞ্চে যাওয়ার রাস্তায় পা বাড়ালেন পুরীর শঙ্করাচার্য। “পুণ্যযোগের সময় পেরিয়ে গেলে কি আর মনষ্কামনা পূর্ণ হবে?”পাঁচ নম্বর জেটিতে দাঁড়িয়ে গজরাচ্ছিলেন ঔরঙ্গাবাদের সুহাস রাও। ৭০ জনের দলে তিনিই নেতা। শঙ্করাচার্য চলে যেতেই তাঁরা ম্যানেজ করে উঠে পড়লেন বিশেষ এক লঞ্চে। আর তার পরেই মহিলা-পুরুষ সবাই হাতে চাল নিয়ে ছুড়তে লাগলেন গঙ্গার জলে। কেউ বা নতুন শাড়ি, রুপোর বেল পাতা, সোনার গয়না বিসর্জন দিতে শুরু করেন মুড়িগঙ্গা নদীতে।
কেন এই সব?
সুহাস বললেন, “মানসিক অউর পূজা কে লিয়ে।”
হোক না গরিব দেশের গরিব মানুষের দলবল, পুণ্যার্জন বলে কথা! |