কামদুনি, গাইঘাটা, মধ্যমগ্রাম, হাবরা, গাইঘাটা। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনায় ধর্ষণ-গণধর্ষণের অভিযোগ-তালিকা।
জেলার সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার দোলতলা পুলিশ লাইনে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের পুলিশকর্তারা। ঠিক তার আগের রাতেই গাইঘাটার শিমুলপুরে এক স্কুলছাত্রীকে মোটরবাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল তিন যুবকের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের সময়টা ওই যুবকরা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখে বলেও অভিযোগ। মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডের ক্ষত শুকোনোর আগেই গাইঘাটার এই ঘটনা ফের জেলার আইন-শৃঙ্খলা, বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। কামদুনি-কাণ্ডের পরে পরে এই গাইঘাটারই রাজাপুরে কিশোরীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। |
শিমুলপুরে শুক্রবার রাতে বছর উনিশের যে তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ, তিনি সদ্য দশম শ্রেণিতে উঠেছেন। ওই ঘটনায় ধরা পড়েছে তরুণীর পড়শি বলরাম ওরফে অপূর্ব মাতা-সহ তিন যুবক। উদ্ধার হয়েছে একটি মোটরবাইক। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় রবিবার জানান, ওই তরুণী গাইঘাটা থানায় গিয়ে ধৃত তিন জনকে শনাক্ত করেছেন। কোন মাঠে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়, তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। রবিবার ধৃতদের বনগাঁ আদালতে তোলা হলে বিচারক ৫ দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তরুণী গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে।
কী হয়েছিল ঘটনার দিন?
নির্যাতিতার পরিবার জানিয়েছে, শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ওই স্কুলছাত্রীর বাবা তাঁকে ঠাকুরনগর বাজারে ডেকে ক্লাসের নতুন বই কিনে দেন। তরণীর সঙ্গে ছিলেন দুই বান্ধবী। গৃহশিক্ষককে বইপত্র দেখাতে বন্ধুদের নিয়ে যান কাছের কোচিং সেন্টারে। বান্ধবীরা দাঁড়িয়েছিলেন একটু দূরে। মাস্টারমশাইকে সেন্টারে না পেয়ে ফিরে আসছিলেন তরুণী।
তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, তখন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল বলরাম। সে তাঁকে ডাকে। প্রথমে উত্তর দেননি তিনি। বলরাম তখন বলে, ‘ভয় কী! আমি তো পাড়ার ছেলে।’ এর পরে বলরামের দিকে এগিয়ে যান ওই তরুণী। আগে থেকেই মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক যুবক। তারা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে মেয়েটিকে জোর করে মোটরবাইকে তুলে নেয়। নতুন কেনা বইপত্র ছিটকে পড়ে রাস্তায়। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যান তরুণীর দুই বান্ধবী।
তরুণীর অভিযোগ, “একটা ফাঁকা মাঠে ওরা মোটরবাইক দাঁড় করায়। মোবাইলে আরও এক জনকে ডেকে নেয় বলরাম। তিন জনে মিলে আমাকে ধর্ষণ করে।” তরুণী জানান, ধর্ষণের ছবি মোবাইলেও তুলে রাখে তারা। ইতিমধ্যে বাবা বারবার ফোন করছিলেন মেয়ের মোবাইলে। ফোন কেটে দেয় অভিযুক্তেরা। চলে মারধর। সঙ্গে হুমকি, কাউকে কিছু জানালে ধর্ষণের ছবি ইন্টারনেটে তারা ছড়িয়ে দেবে। ওই তরুণী বলেন, “খুনেরও হুমকি দিয়ে ওরা বলে, ভবিষ্যতে যেন ডাকলেই আমাকে পাওয়া যায়!”
ঘণ্টা দু’য়েক পরে মেয়েটিকে মোটরবাইকে তুলেই দুই যুবক বাড়ি থেকে খানিক দূরে নামিয়ে দিয়ে যায়। রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। বিধ্বস্ত অবস্থায় কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছন তিনি। শনিবার সকালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বলরাম ছাড়াও অ্যান্টনি রাজকুমার গোমস ও জিকো কীর্তনিয়া নামে দুই যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। ঠাকুরনগর এলাকা থেকে শনিবার রাতে ধরা পড়ে তিন জন।
এ দিন ওই তরুণী বলেন, “কামদুনির ঘটনা শুনেছিলাম। সেই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কথাও হয়। কিন্তু, আমার সঙ্গেই এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটবে, কখনও ভাবিনি! বেঁচে ফিরব, সে আশাও ছিল না।”
মধ্যমগ্রাম-কাণ্ড নিয়ে নানা মহলের সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্য। তাই এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টার কসুর করছে না প্রশাসন। তরুণীর বাড়িতে যান গাইঘাটার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর, হাবরার বিধায়ক তথা আর এক মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও। মেয়েটির মা অপরাধীদের চরম শাস্তির দাবি জানান জ্যোতিপ্রিয়র কাছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা পরিবারটির পাশে দাঁড়াব। অপরাধীরা নিস্তার পাবে না।” লিজ নেওয়া জমিতে চাষবাস করে কোনও মতে সংসার চালান তরুণীর বাবা। পরিবারটির জন্য অন্ত্যোদয় কার্ডের ব্যবস্থা করার নির্দেশ প্রশাসনকে দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।
জেলার কিছু এলাকায় কেন মহিলাদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ঘটেই চলেছে, শনিবার জেলা পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে সেই প্রশ্ন তুলে উদ্বেগ জানান স্বরাষ্ট্রসচিব। পুলিশ-প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন। এর পরে জেলার সব থানা এলাকায় মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ব্যাপক প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এসপি তন্ময় রায়চৌধুরী জানান, মহিলাদের নিরাপত্তায় বিশেষ হেল্পলাইন চালু হচ্ছে। লিফলেট-পোস্টার, মাইকেও সেই ফোন নম্বর উল্লেখ করে প্রচার হবে। কাজের প্রয়োজনে বাড়ির মেয়েরা ভিন্ রাজ্যে গেলে তা-ও পুলিশকে আগাম জানাতে বলা হচ্ছে। এর থেকেই স্পষ্ট, মহিলাদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে পুলিশ। এই জেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। ডিএম সঞ্জয় বনশল এবং এসপি থাকবেন এর তত্ত্বাবধানে। আইনি সহায়তার দিকটি দেখবেন বারাসত আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মহেশ্বর ভট্টাচার্য। পঞ্চায়েত-স্তরেও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালানো হবে, জানান জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা বিবি। |