ইডেনে বেলাইন রেল, বাংলার লক্ষ্মীলাভ
ল ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে গ্যালারির অভিবাদনে ডুবে গোটা টিম। কারও হাতে স্টাম্প। কেউ টুপি খুলে দর্শকদের সেলাম জানাচ্ছেন। কেউ নাচছেন।
নিমেষে ভিড় বি ব্লকে। সাদা জার্সিদের কাছ থেকে দেখতে রেলিংয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে উন্মত্ত জনতা।
গোটা ক্লাবহাউস তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। হাততালি আর চিৎকারে গমগমে রবিবারের ইডেন।
যাঁদের ঘিরে শীতের দুপুরের ইডেনে এত উষ্ণতা, তাঁরা তখন একে একে ড্রেসিংরুমে ঢুকছেন।
ওই তো শিবশঙ্কর পাল। দিনের সবচেয়ে দামী উইকেটের মালিক। তাঁর আউটসুইঙ্গারে খোঁচা মেরে অরিন্দম ঘোষ কিপারের হাতে জমা না পড়লে বাঙালির রোববারটা হয়তো এত মিষ্টি হতো না। ২০০৯-এ চোট পাওয়ার পর যাঁকে নিয়ে বলা হয়েছিল, ওর তো কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল। ‘শেষ’ হয়ে যাওয়া যে পেসার ম্যাচ শেষ করলেন পাঁচ উইকেট নিয়ে। ‘গাংনাম’ নাচতে নাচতে!
ওই তো সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। শান্ত, লাজুক বাঁ-হাতির ৯৬ বাংলার ক্রিকেটপ্রেমী কি সহজে ভুলবে? ভুলবে, দরকারে ওই শান্ত ছেলেও আগুন হতে জানেন?
ওই তো অশোক দিন্দা। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে নিজের বুকে ঘুসি মেরে আনন্দে চিৎকার করছেন। টিমের বোলিংকে অক্লান্ত ভাবে, প্রায় একা হাতে যিনি না টানলে বাংলার রঞ্জি স্বপ্ন হয়তো এত দিন বেঁচে থাকত না।
ওই তো সৌরভ সরকার। পরপর দু’বলে দিনের শেষ দুটো উইকেট তুলে যিনি রঞ্জি সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিকের সামনে।
আর ওই তো ক্যাপ্টেন নিজে। ক্যাপ্টেন, না পরশমণি? মনোজ তিওয়ারি নেই, মহম্মদ শামি নেই। এই ম্যাচের আগে পাননি ঋদ্ধিমান সাহা-কেও। হাতেগোনা কিছু সিনিয়র আর আনকোরা কিছু চরিত্র নিয়ে তৈরি করেছেন এমন এক সমষ্টি, যাকে আক্ষরিক অর্থে ‘টিম’ বলা চলে।
টিম এলআরএস!
দুই নায়ক

রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনাল জেতার পরে শিবশঙ্কর পালের কোলে অধিনায়ক
লক্ষ্মীরতন শুক্ল। রবিবার ইডেনে শঙ্কর নাগ দাসের তোলা ছবি।
আর যদি বলা হয়, এই টিমের হাত ধরে বঙ্গ-ক্রিকেটের পুনর্জন্ম হল, তা হলে বোধহয় খুব ভুল হবে না। না হলে একটা রঞ্জি ম্যাচ ঘিরে এত আগ্রহ, টানা পাঁচ দিন মাঠে এত ভিড়, নাগাড়ে ‘বাংলা, বাংলা’ চিৎকার, ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টির ট্রেডমার্ক গ্যালারি-গর্জন মাঠ ছাপিয়ে আশপাশের ময়দানে ছড়িয়ে পড়া, বিপক্ষ টিমকে দর্শকদের অক্লান্ত স্লেজিং, এত তুকতাক, এত টেনশন শেষ কবে দেখেছে ইডেন? নমুনা মুম্বই ফেরত বিমানবন্দর থেকে সোজা মাঠে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। নমুনা ম্যাচের পাঁচ দিন একই পাঞ্জাবি পরে আসা সিএবি কর্তা। নমুনা লক্ষ্মী-দিন্দাদের দিকে অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে দিতে দিতে খুদে ভক্তদের আবদার, দাদা ট্রফিটা চাই।
এগুলো যদি অক্রিকেটীয় দিক হয়, তা হলে ক্রিকেটীয় যুক্তিও কম নেই। ২০০৬-’০৭ মরসুমে দীপ দাশগুপ্ত-র টিমের পর এই প্রথম রঞ্জির শেষ চারে বাংলা। তা-ও আবার পরপর তিনটে ম্যাচ সরাসরি জিতে। গত অর্ধ দশকেরও বেশি রঞ্জি মানে ছিল বাংলার ব্যর্থতার গল্প। গ্রুপ থেকেই বিদায়ের ট্র্যাজেডি। সঙ্গে যোগ করুন টিমের মধ্যে বিভাজন, কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়দের মতবিরোধ-জাতীয় খুচরো বিতর্ক। সেই গুমোট অন্ধকারে লক্ষ্মীর টিম যেন দমকা হাওয়ার স্বস্তি।
যে টিমের প্রত্যেক প্লেয়ার একে অন্যকে সমানে ‘ব্যাক’ করে যায়, যে টিমের অধিনায়ক বলে দেন, “আমার টিমে সবাই ক্যাপ্টেন,” যে টিমের কোচ এক সিনিয়রকে বলে দিতে পারেন, “ইন্ডিয়া খেলে আয়। আমরা তো কোয়ালিফাই করবই। তখন তুই খেলবি,” সেই টিমের রঞ্জি সেমিফাইনালে ওঠাটা গভীর ক্রিকেট রোম্যান্সের উপাদান নয় তো কী?
কোয়ার্টার-যুদ্ধ জয়ের অন্যতম বড় তৃপ্তির কারণ অবশ্যই ম্যাচের নাটকীয় সব ‘টুইস্ট’ পেরিয়ে অক্ষত থাকা। এ দিন যেমন মেঘলা পরিবেশের জন্য খেলা শুরু এক ঘণ্টার বেশি পিছিয়ে যাওয়ায় ধরে নেওয়া হচ্ছিল, বাংলাই এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারবে। কিন্তু রেলের দুই ব্যাটসম্যানের প্রথম আধ ঘণ্টার সাবলীল স্ট্রোক প্লে দেখে মনে হচ্ছিল, রানটা আর একটু বেশি হলে ভাল হত। তখনও অরিন্দম ঘোষ খেলে যাচ্ছেন। তখনও নামেননি মহেশ রাওয়াত। একটু পরে নীতিন ভিল্লে-কে ফিরিয়ে দিলেন দিন্দা। আসল ব্রেক-থ্রুর নায়ক কিন্তু সেই লক্ষ্মীই। তাঁর দ্বিতীয় ওভারে রাওয়াত প্লে-ড অন হয়ে বোল্ড হওয়ার পরেই যেন নতুন আগুন নিয়ে বল করতে শুরু করেন শিবশঙ্কর। রাওয়াত ফিরে যাওয়ার তিন ওভারের মধ্যে শিবের শিকারের তালিকায় অরিন্দম, রেল ১৭৯-৬, আর ম্যাচের লাগাম বাংলার হাতে। লাঞ্চের পর দশ ওভারের মধ্যে সহজ-কঠিন মিলিয়ে চারটে ক্যাচ পড়ে যাওয়ায় ইডেনের সমবেত হৃদস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য কেঁপে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রেলের শেষ চারটে কামরা লাইনচ্যুত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
রবিবার দুপুর-দুপুর রেল-বধ শেষ করে ড্রেসিংরুমে ছোটখাটো পার্টি করছিলেন লক্ষ্মীরা। সিএবি-র লবি ঠাসা লোক, রাস্তায় জড়ো শ’পাঁচেক ক্রিকেট-ভক্তের ধাক্কায় সিএবি-র গেট ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। এ সবের মধ্যেই কখন যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ তাঁর। তিনি মুরলী কার্তিক। দুটো ম্যাচ ধরে বাংলার সবচেয়ে ‘প্রিয়পাত্র’ রেল অধিনায়ক। যাঁর অস্তিত্ব যেন কোথায় হারিয়ে গেল রবিবার লক্ষ্মীদের ঘিরে নজিরবিহীন উন্মাদনায়। যাঁর ভাগ্যে জুটল হারের উপর উপেক্ষার ‘উপহার’।
‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে না?

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলা ৩১৭ ও ২৬৭
রেলওয়েজ ৩১৪ ও ২২২ (কার্তিক ৫৬, লক্ষ্মী ৩-৪৫, শিবশঙ্কর ২-৪৭, সৌরভ ২-২২, দিন্দা ২-৭৭)

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.