|
|
|
|
|
|
জমে থাকা ডায়েরিগুলো বাতিল করে দেবেন না।
লিখুন। লেখার অভ্যেস তৈরি করুন নতুন করে।
লিখছেন ঋতা ভিমানি। |
|
নতুন বছরের শুরু হলে বেশ কিছু নতুন ডায়েরি হাতে এসে পড়েই। দেখতে খুব সুন্দর লাগলেও ওগুলো টেবিলের পাশে বা দেরাজে কেবলমাত্র সংগ্রহ হয়েই জমতে থাকে। কখনও বা টেবিল আর দেরাজ খালি করার জন্য অন্য কাউকে উপহার দিয়ে দেওয়া হয়। একটা দুটো রাখা থাকে নিজের কাজের প্ল্যান বা হিসেবপত্র করার জন্য। বাড়ির অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদেরও দিয়ে দেন। তারা স্কুল-কলেজে নোটস নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে।
ডায়েরির এই অতি পার্থিব ব্যবহার থেকে একটু অন্য রকম ভাবে ভাবলে দেখবেন মনের জানলা খুলে গিয়েছে। জীবনটা তো শুধু হিসেবেনিকেশ করা নয়, আর নোটস নেওয়াও নয়। আমরা যতই বাস্তবতার মধ্যে থাকি না কেন জীবনের কিন্তু একটা বৃহত্তর অর্থ আছে।
বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন অফিস থেকে আসা ডায়েরিগুলো তাদের নিজস্ব প্রচার বাড়ানো এবং শুভেচ্ছা পাঠানোর পদ্ধতি হলেও সেগুলোকে ভাল কাজে লাগানোর কথা ভেবেছেন কখনও?
কী ভাবছেন? ডায়েরি লেখা আপনার পোষায় না? কিন্তু কেন? আপনার ডায়েরি লেখার সময় নেই? নাকি কী লিখবেন সেটা বুঝতে পারেন না? আমার তো মনে হয় ডায়েরি লিখলে জীবনের নানা দিকের প্রতি মনোযোগ বাড়ে। রোজকার জীবনেও একটা শৃঙ্খলা আসতে পারে। ডায়েরিতে লিখতে পারেন সারা দিনের নানা ঘটনা। কোথায় কোথায় গেলেন, কাদের সঙ্গে দেখা হল, কী করলেন, কী খেলেন— সব কিছুই লেখা যেতে পারে খুব আটপৌরে স্টাইলে। এমনকী নিজের কাজের জগতের কথা, কী ভাবে অফিসের কোন প্রজেক্ট সামলাচ্ছেন, সহকর্মীদের সঙ্গে সারা দিনে কেমন কথাবার্তা বললেন, এ সবও ধরে রাখা যেতে পারে ডায়েরিতে।
শুনতে একঘেয়ে লাগছে? কিন্তু বিশ্বাস করুন, যদি একবার রোজনামচা লিখতে শুরু করেন, দেখবেন সেটা একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধরুন আপনি অসুস্থ হয়েছেন। সেই সময়টা কী ভাবে কাটল, সেই অসুস্থতার সময় কারা আপনার পাশে ছিলেন, সে সব কথা যদি লিপিবদ্ধ করে রাখেন, তা হলে সেটাও কিন্তু ভবিষ্যতের সম্পদ হয়ে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম আপনার ডায়েরি পড়ে জানতে পারবে আপনার জীবনের একটা বিশেষ সময়ের খুঁটিনাটি। এবং সেগুলো জেনে তাদের ভালই লাগবে। |
|
ডায়েরি হল নিজের মনের কথা খুলে লেখার মাধ্যম। এতে আপনার মানসিক চাপ দূর হয়, জমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলোকে উজাড় করে দেওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ হলেও আসলে কিন্তু তার প্রাণ আছে। সে আপনার এমন বন্ধু যে কথা শুনবে, কিন্তু হয়রানি করবে না, পাল্টা জবাব দেবে না। অথচ আপনার মনের সব আবেগ কিংবা অস্থিরতা শুষে নেবে।
প্রতি বছরই আমরা অনেক জন্ম-মৃত্যু দেখি। বিবাহ দেখি। বিবাহ বিচ্ছেদও দেখি। এ সব ঘটনাই আমাদের মনে নানা ভাবে রেখাপাত করে যায়। আত্মীয় স্বজন-চেনা-পরিচিত-বন্ধুবান্ধব-পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে নতুন কেউ জন্মালে যে অনুভূতিটা হয়, বা তার জন্মানো আপনার জীবনকে কতটা আলোড়িত করেছে সুন্দর করে লিখে রাখতে পারেন তাও। তেমনি ভাবে প্রিয়জনের চলে যাওয়া, এই চির বিচ্ছেদের মুহূর্তে আপনার মনে জেগে উঠতে পারে পুরনো কত স্মৃতি! সব ধরে রাখুন ডায়েরিতে।
তা ছাড়া আর একটা ব্যাপারও মনে রাখবেন যে ডায়েরি হয়ে উঠতে পারে আপনার সৃষ্টিশীল মননের প্রকাশমাধ্যম। আপনার কাব্যিক মনোভাব প্রকাশ পেতে পারে ডায়েরিতে আপনারই কলমের আঁচড়ে। এমনও হতে পারে ডায়েরির পাতা জুড়ে এই সব টুকরো টুকরো লেখা একদিন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হল। বড় বড় নেতৃস্থানীয় মানুষেরা যদি নিয়মিত ডায়েরি না লিখতেন এবং তা যদি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত না হত, আমরা সমাজের ইতিহাস কিংবা সামাজিক রদবদলের গতিপ্রকৃতি জানতেই পারতাম না।
আমার প্রপিতামহের পিতা শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন তখনকার দিনের পণ্ডিত মানুষ, শিক্ষাবিদ। এবং সেই সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক। ঊনিবংশ শতক এবং বিংশ শতাব্দী—তিনি দুইই দেখেছিলেন। ১৮৮০ সালে তিনি ইংল্যান্ডে যান। প্রকাশ করেন ‘আত্মচরিত’। সেখানে গিয়েই লেখেন ইংল্যান্ডের ডায়েরি। সেই ডায়েরি বই হিসাবে প্রকাশিতও হয়। ব্রিটেনে যে পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছিল সবই লিখেছিলেন ডায়েরিতে। সেই সময়ের সব ঘটনাই ডায়েরিতে নথিভুক্ত করেছিলেন। ওই ডায়েরি ছাড়া সেই অস্থির সময়কে বোঝা রীতিমতো কঠিনই হত। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক হিসেবে সেই সময়কার অনেক ঘটনাই তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে। বাংলার নবজাগরণের যুগের ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে সেই বই।
তার অনেক অনেক বছর পর আশ্চর্য ভাবে আমার মা তপতী মুখোপাধ্যায় পৌঁছে যান ইংল্যান্ডে। তিনি ছিলেন লেখিকা। ১৩ বছর বয়সে লেখেন ‘বিলেতের ডায়েরি’। সেই রচনা তখনকার দিনের পাক্ষিক শিশু পত্রিকা ‘মুকুল’য়ে বেরিয়েছিল। এই পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক গণ্যমান্য মানুষজনই ডায়েরি লেখায় অভ্যস্ত ছিলেন। পরবর্তী কালের বহু ঐতিহাসিকই সামাজিক বদলের চিত্রটা পেয়েছেন এই সব ডায়েরি থেকেই। মনে করে দেখুন কী ভাবে অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি এক সময় বেস্ট সেলার হয়ে উঠেছিল। নেদারল্যান্ড যখন নাৎসি শক্তির দখলে, তখন অ্যান ফ্র্যাঙ্ক তার পরিবারের সঙ্গে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে থেকে লিখেছিলেন এই ডায়েরি। মোট ষাটটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল সেই ডায়েরি।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ডায়েরি লেখক স্যামুয়েল পেপিস। অষ্টাদশ শতাব্দীর নৌপ্রশাসক এবং সাংসদ ছিলেন তিনি। দশ বছর ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেখা স্যামুয়েলের ডায়েরিতে ধরা আছে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। ধরা আছে সমসাময়িক নানা ঘটনার চিত্রও। লন্ডনের গ্রেট প্লেগ, গ্রেট ফায়ার, দ্বিতীয় ডাচ যুদ্ধের বিশদ বিবরণ আছে তাঁর ডায়েরিতে। ব্যক্তিগত অনিরাপত্তার কথা বলার সময় দেশের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্পর্কেও নিজের মন্তব্য রেখেছেন।
ঘরের কাছের কথা ধরা যাক। তালিবানিদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে রেখেছিলেন, ‘মোল্লা ওমর, তালিবান ও আমি’ স্মৃতিচারণায়। সেই সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় আফগানিস্তানে জঙ্গিদের হাতে নিহত হলেও তার সেই স্মৃতিচারণা কিন্তু সমসাময়িক তালিবানশাসিত আফগানিস্তানের দলিল হয়ে রয়ে গেল।
মূল কথায় ফিরি। রোজকার নিয়মের মধ্যেই ফেলে দেওয়া যায় ডায়েরি লেখা। দিনেই হোক বা রাতে—দু’দণ্ড সময় করে লিখে ফেলুন সারা দিনে এমন কিছু ঘটনা যা আপনার মনে দাগ কেটে গিয়েছে। লিখতে পারেন এমন কোনও বইয়ের কথা, যা পড়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
সুন্দর সুন্দর ডায়েরি পাওয়াও একটা মজার খেলা। আমি ডায়েরিগুলো পাই ডিসেম্বরের শেষে। এগুলো যাকে বলে একেবারে পকেটফ্রেন্ডলি ডায়েরি। এই সব ডায়েরিতে একটা করে ছোট ছোট বই থাকে, যেগুলো প্রত্যেক মাসে একবার করে বদলে নিতে হবে। আমার নাম খোদাই করা আছে, এই রকম একটা ডায়েরি আমি বেছে নিই। এই ডায়েরির সঙ্গে থাকে একটা অ্যাড্রেসবুক, একটা ছোট নোট প্যাড, ডায়েরিটা ওয়ালেটের মতো দেখতে একটা কভারের ভেতর রাখা থাকে। আমি তো মাঝে মাঝেই ওই কভারটার মধ্যে আমার ‘এক্সট্রা’ টাকাপয়সা রাখি। এক সময় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে থাকাকালীন এই ধরনের ডায়েরি তৈরি করাতাম। আর লোকে লাইন দিয়ে থাকত সেই ডায়েরি হাতে পাওয়ার জন্য।
ভেবে দেখুন আপনার জীবনে এমন কোনও দিন নেই, যে ডায়েরিতে লেখার রসদ আপনি জোগাড় করতে পারছেন না। জীবনে এত গল্প আর ঘটনা ছড়িয়ে আছে প্রতিমুহূর্তে! কে বলতে পারে যে পরের বেস্ট সেলিং লেখক হয়তো আপনিই হয়ে গেলেন। |
|
|
|
|
|