অ্যান্টনি যখন আকাশে
বেহালা টু বোলপুর। হেলিকপ্টারে প্রসেনজিৎ। সঙ্গে সৃজিত।
কেমন লাগল এই উড়ান? জানাচ্ছেন ‘জাতিস্মর’য়ের পরিচালক |
এই প্রথম আমার হেলিকপ্টারে চড়া।
সফর শেষে বারবার মনে হচ্ছিল একটাই কথা, এ যেন আমাদের ‘ক্লাউড নাইন’য়ে ভেসে যাওয়ারই অভিজ্ঞতা।
প্রথমবার হেলিকপ্টারে চড়ব বলে যে ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। তবে রবিবার সকালে উঠেই দেখি কুয়াশা। তাই সামান্য ধন্দ ছিল মনে। এই আবহাওয়ায় আদৌ অতটা পথ যেতে পারব? দৃশ্যমানতা ঠিক থাকবে তো?
সে নিয়ে ফ্লাইং স্টেশনের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েক বার কথাও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বেহালা ফ্লাইং স্টেশনে পৌঁছে জানলাম যে চিন্তার কোনও কারণই নেই।
এই ফ্লাইং স্টেশনটা অনেক দিনই বিকল হয়ে পড়ে ছিল। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, এত ভাল একটা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। তাঁর তৎপরতাতেই এ রকম একটা অভিনব হেলিকপ্টার যাত্রার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে জনসাধারণের জন্য। গঙ্গাসাগর, মালদা, বীরভূম, কোচবিহার— যে সব জায়গায় হেলিপ্যাড রয়েছে, সেখানেই এই ব্যবস্থা শুরু করার প্রস্তাব রয়েছে। জনসাধারণের কাছে এটা একটা বড় প্রাপ্তি। এর পর আমরা যখন রেকি করতে যাব, তখনও এই সার্ভিসটা সময় বাঁচাতে অনেক সাহায্য করবে। |
|
হচ্ছেটা কী?
হেলিকপ্টারে চড়ার শখ আগেও ছিল। কিন্তু কোনও দিন তা হয়ে ওঠেনি। ‘মিশর রহস্য’য়ের সময় হেলিক্যাম ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হয়নি। রিলায়ান্স এন্টারটেনমেন্টের ‘জাতিস্মর’য়ে প্রথম হেলিক্যাম ব্যবহার করেছি। যখন বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)-র কাছে প্রথম শুনি যে, এই রকম একটা সফরে আমরা যেতে পারব, তখন দারুণ ‘এক্সাইটেড’ ছিলাম। হেলিকপ্টারে উঠেই দেখলাম সিটবেল্টগুলো বেশ অন্য রকম।
এত কাছ থেকে কোনও দিন ককপিটের ‘অ্যাকটিভ ফ্লাইং প্যানেল’ এর আগে দেখিনি। হেলিকপ্টার চলাকালীন সেটা দেখাও বেশ একটা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। একটু টেনশন হচ্ছিল, কিন্তু সেটাও কেটে গেল দুই পাইলটের সঙ্গে কথা বলে। ওঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল এই সফর যেন মিনিবাসে করে ঢাকুরিয়া থেকে সেলিমপুরে যাওয়ার মতোই সহজ একটা ব্যাপার!
আকাশের নীচে মানুষ
সিটে বসেই প্রথমে নজরে পড়ল যে পাখাটা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। মনে পড়ে গেল সুমনদার সেই ‘হেলিকপ্টার’ গান। আমাদেরকে হেডফোন দিয়ে দেওয়া হল যাতে ওই প্রচণ্ড আওয়াজটা কানে না আসে। তার পর একটু এ-দিক ও-দিক নড়তে নড়তে হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। এমনিতে অ্যারোপ্লেন টেক-অফের সময় আমি বেশ সজাগ থাকি। ভাল লাগে দেখতে যখন রানওয়ে থেকে প্লেনটা আকাশে উড়ে যায়। |
‘এ তুমি কেমন তুমি’:
রূপসী বাংলাকে দেখে মুগ্ধ |
‘বলো হে অ্যান্টনি’:
বোলপুরে মঞ্চের সামনে তখন বারো হাজার |
|
হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে দেখলাম তা কিন্তু বেশি উঁচুতে উড়ল না। মেঘেদের মিনারে পৌঁছোনো না গেলেও এর জন্য একটা উপরি পাওনা হল আমাদের। নীচে তাকিয়ে অনেক ‘ইন্টারেস্টিং ডিটেল’ চোখে পড়ল। মনে হল বাংলার মুখ সত্যি দেখলাম আবার। সে কী শ্যামল মুখ! যে জায়গাগুলোতে ‘জাতিস্মর’য়ের শ্যুটিং করার আগে রেকি করেছি, সেই জায়গাগুলোকেই আমরা টপ শটে দেখতে পেলাম।
বেহালা থেকে বোলপুর
শুধু যে হেলিকপ্টারে করে বোলপুরে যাওয়ার আনন্দ নিয়েই ফিরলাম তা নয়। ‘জাতিস্মর’ সিনেমার সঙ্গে বোলপুরের নাড়ির টান। অ্যান্টনি তো হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে এক জন পর্তুগিজ সঙ্গীতকার থেকে বাঙালি কবিয়াল হয়ে ওঠেননি। এই রূপান্তরের পেছনে অনেক অবদান ছিল লোকগান শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয়ের। আর এই সব লোকগীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল বোলপুর। বোলপুরে নামার পর আমরা একটা অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে বাউলরা এসে গান ধরলেন। অনুষ্ঠানের শেষে লালন ফকিরের ‘জাত গেল’ গানটা গাইলেন এক বাউল। এই গানটার সঙ্গে বুম্বাদার একটা অন্য রকম যোগ। ‘মনের মানুষ’ ছবিতেও এই গানটা ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘জাতিস্মর’য়েও আমরা সেটাই ব্যবহার করেছি। |
‘সহসা এলে কি’: সফর শেষে বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে |
হিউম্যান হেলিকপ্টার
ফেরার পথে খানিকটা তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। ‘জাতিস্মর’য়ের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আবার ‘চতুষ্কোণ’য়ের প্রি-প্রোডাকশনের কাজও চলছে। তাই হয়তো একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।
তবে তা ক্ষণিকের জন্য। একটু ঘুরপথে ফিরলাম দুর্গাপুর বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে। কী সুন্দর লাগছিল রানওয়ের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে।
সফর শেষে একটা কথা মনে হল। কেমন হয় যদি বুম্বাদার একটা নতুন নাম দেওয়া যায়? যদি ওঁকে ডাকা হয় ‘হিউম্যান হেলিকপ্টার’ বলে?
কারণ? হেলিকপ্টারের কাজ তো দূরত্ব কমিয়ে আনা। চার ঘণ্টার দূরত্বকে কমিয়ে চল্লিশ মিনিটে নিয়ে আসা।
তিরিশ বছর ধরে তো বুম্বাদা এই রকম কত দূরত্বই কমিয়ে এনেছেন। ক্রমাগত করে এসেছেন শহর আর মফস্সলের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন।
বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠে আমরা যখন ল্যান্ড করেছিলাম সেখানে বারো হাজার মানুষের ঢল। সেতুবন্ধনের কাজটা বিগত কয়েক দশক ধরে এতটা নিখুঁত ভাবে করে এসেছেন বলেই তো আজও তিনি এই রকম জনপ্রিয়।
ক্লাউড নাইনের সফর-শেষে তাই বুম্বাদাকে দিলাম নতুন নাম।
অ্যান্টনি হলেন টলিউডের মানব হেলিকপ্টার। |
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
|