সরকারি হাসপাতালে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের নীতি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ওষুধ কেনা, তার গুণগত মান বজায় রাখা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত তা সরবরাহ কত দূর সুনিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে গোড়াতেই দেখা দিয়েছে একগুচ্ছ প্রশ্ন ও সংশয়। স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি: দুর্নীতির ছোঁয়া এড়িয়ে ঘোষিত নীতিটি কার্যকর করার লক্ষ্যে তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যার সাহায্যে আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে বরাত দিয়ে দেওয়া যাবে। তার পরে, কার্যত নির্ধারিত সময়েই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ চালু হয়ে যাবে বলে আশা করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।
স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ স্বীকার করেছেন, এত দিন যে ব্যবস্থা চালু ছিল, তাতে দুর্নীতির সুযোগও বিলক্ষণ ছিল। তবে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওষুধ খরিদ, বিল তৈরি ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে যে ভাবে জোর দিয়েছেন, তাতে ফল মিলছে। হাসপাতাল-ভিত্তিক সরবরাহে কর্মী-অফিসারদের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। এক স্বাস্থ্য-কর্তা জানাচ্ছেন, আগে কোনও জেলায় ওষুধের প্রয়োজন হলে কলকাতার সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স (সিএমএস)-এ বার্তা আসত। সিএমএসের ভাঁড়ারে ওষুধটি মজুত থাকলে তারা জেলায় পাঠাতো, জেলা সদর থেকে তা যেত সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে। সিএমএসে ওষুধ না-থাকলে ফের টেন্ডার ডেকে ওষুধ কিনে জেলায় পাঠানো হতো। |
স্বভাবতই পুরো ব্যাপারটায় সময় লাগত বিস্তর। অনেক সময়ে দেখা যাচ্ছিল, ওষুধ হাসপাতালে পৌঁছাল যখন, তত দিনে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। অথচ দরকারের মুহূর্তে রোগীদের তা দেওয়া যায়নি। এ বার এই গলদ দূর করার চেষ্টা হয়েছে। জেলায় জেলায় ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে সিএমএসের কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে? স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: এখন জেলাগুলো প্রয়োজনীয় ওষুধের বরাত নিজেরাই দেয়, নিজেরাই ওষুধ কেনে, বিল মেটায়। এবং পুরো প্রক্রিয়াটি চলে নির্দিষ্ট একটি প্রাযুক্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে, যার উপরে স্বাস্থ্য ভবনের সরাসরি নজরদারি থাকে। স্বাস্থ্য-কর্তারা কলকাতায় বসে কম্পিউটারের মাউসের ক্লিকেই জেনে নিতে পারেন, কোন জেলার কোন হাসপাতাল কবে কী ওষুধের বরাত দিয়েছে, কোন সংস্থাকে। কত টাকার বরাত, কবে ওষুধ সরবরাহ হয়েছে কিংবা কখন টাকা মেটানো হয়েছে, সে সব তথ্যও স্বাস্থ্য ভবনের হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লেই সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে নথি তলব করা হচ্ছে।
পরিণামে বিনামূল্যের ওষুধ খরিদের প্রক্রিয়ায় অনেক স্বচ্ছতা এসেছে বলে কর্তাদের দাবি। ঠিক কী ভাবে পরিচালিত হচ্ছে ব্যবস্থাটি?
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, গোটা প্রক্রিয়া তদারকির স্বার্থে তৈরি হয়েছে একটা সফ্টওয়্যার স্টোর ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এসএমইএস)। এখন বছরের শুরুতেই বারো মাসের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দরপত্র চাওয়া হয় প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে। টেন্ডারে দর ও কোম্পানি ঠিক হলে তাদের নাম, ওষুধের নাম ও দর সবই সফ্টওয়্যারে তুলে দেওয়া হয়। কোনও জেলার কোনও হাসপাতালে ওষুধ দরকার পড়লে তারা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এমএমইএস মারফত সরাসরি অর্ডার দেয়। সংস্থাটির পাঠানো ওষুধ জেলায় পৌঁছলে সফ্টওয়্যারটিতে একটি রসিদ (গুডস রিসিপ্ট নোট, সংক্ষেপে জিআরএন) তৈরি হয়, যা থেকে বোঝা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট ওষুধ সরবরাহ হয়েছে। এর পরে হাসপাতাল অনলাইনেই ওষুধ সংস্থাকে টাকা মিটিয়ে (ই-পেমেন্ট) দেয়।
ওই কর্তা জানাচ্ছেন, স্বচ্ছ্বতা বজায় রাখতে তালিকাভুক্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা, সরবরাহকারীও এমএমইএসে ঢোকার ‘পাসওয়ার্ড’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে নিজেরাই জেনে নিতে পারে, বরাতপ্রাপ্তি থেকে অর্থপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া কোন অবস্থায় রয়েছে। স্বাস্থ্য-সূত্রের বক্তব্য: পুরোপুরি কর্মীনির্ভর পদ্ধতিতে ওষুধ খরিদ ও সরবরাহ চলাকালীন দু’টি অভিযোগ বারবার উঠত। প্রথমত, এমন ওষুধ জেলায় পাঠানো হয়েছে, যার মেয়াদ ফুরনোর সময় (এক্সপায়ারি ডেট) প্রায় দোরগোড়ায়। দ্বিতীয়ত, বরাত দেওয়া থেকে বিল মেটানো পদে পদে ঘুঘুর বাসা। এমএমইএস-জমানায় এমন অভিযোগের অবকাশ কম। কেন?
কর্তাদের ব্যাখ্যা, এখন ওষুধ বিলির ক্ষেত্রে ‘ফার্স্ট ইনস ফার্স্ট আউট (ফিফো)’ নীতি বলবৎ হয়েছে। অর্থাৎ যে ওষুধ গুদামে আগে এসেছে, তা আগে বেরোবে। সফ্টওয়্যারের দৌলতে এতে কারচুপির সুযোগও নেই। উপরন্তু বরাত প্রদান বা মিল মেটানোয় স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী-অফিসারদেরও ভূমিকা থাকছে না। পুরোটাই অনলাইনে সম্পন্ন হওয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা কমেছে।
কিন্তু ই-প্রথাতেও কি ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই? দফতরের একাংশের দাবি, সুযোগ আছে। তবে নজরদারির জালে তা সরাসরি ধরে ফেলা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণও দিচ্ছেন তাঁরা। কী রকম?
জানিয়েছেন, কিছু দিন আগে একটি জেলা প্রয়োজন ছাড়াই আচমকা একটা ওষুধের প্রচুর অর্ডার দিয়েছিল। এসএমইএস মারফত তা দেখে স্বাস্থ্য ভবনের সন্দেহ হয়। কাগজপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। তাতে ধরা পড়ে, ওখানে অনিয়ম হচ্ছিল। আর এক জেলায় ওষুধের বিল বাবদ এক মাসে মোটা বিল মেটানো হয়েছে দেখে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়েছে। “অনলাইন পদ্ধতিতে প্রস্তুতকারীর কাছ থেকে জেলায় ঠিক সময়ে ওষুধ পৌঁছচ্ছে। এ বার যাতে জেলা সদর থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাওয়ামাত্র ওষুধ পৌঁছে যায়, মাস দুয়েকের মধ্যে আমরা তার ব্যবস্থা করব।” বলছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব মলয়কুমার দে।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে বছরে অন্তত এক কোটি মানুষ সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার সুযোগ নেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত নীতি কার্যকর হলে সরকারি হাসপাতালে আসা ৯৮% রোগী নিখরচায় ওষুধ পাবেন। স্বাস্থ্য-সচিবের কথায়, “তিন বছর আগে এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলির জন্য বছরে সাকুল্যে ৮০ কোটি টাকার ওষুধ কেনা হতো। এ বছর রাজ্য সরকার নিজে ৪০৩ কোটির ওষুধ কিনেছে। কেন্দ্রীয় অর্থে কেনা হয়েছে ১০০ কোটির ওষুধ।”
পরের বছরে অন্তত ছ’শো-সাড়ে ছ’শো কোটি টাকা এই খাতে ব্যয় হতে পারে বলে জানিয়েছেন সচিব। |