মার প্রথম বই ‘ঝাঁসীর রাণী’। ১৮৫০-এর দশকে ভারতে সেনা বিভাগে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত সেনা বিভাগে সিপাহিরা তাদের নিজস্ব নানা কারণে বিদ্রোহী হয়। ইতিহাসে এটি ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলে পরিচিত। সিপাহিদের বিদ্রোহী হওয়ার পিছনে অনেক কারণ ছিল। তখনও দেশে ট্রেন চলাচল হয় না, বিদ্যুতের প্রচলন হয়নি। তা সত্ত্বেও সিপাহিদের সেনা-ছাউনি থেকে ছাউনিতে বিদ্রোহ-বার্তা ছড়িয়ে যায়।
সে দিনের বাংলা সহ সর্বত্র সেনা-ছাউনিগুলি বিদ্রোহী হয়। ১৮৫৭-র ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ এ ভাবেই ছড়িয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের বিষয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীবাই? কেমন করে তাঁর বিষয়ে লিখব, সে কথা ভাবতে বসে আমি অকূল পাথারে পড়েছিলাম।
প্রথম খোঁজ পাই একটি মরাঠি ভাষায় লেখা বইয়ের। লেখকও মরাঠি। ডি ভি পারসনীশ। বইয়ের নাম ‘ঝাঁসীচ্যা মহারানী লক্ষ্মী বাইসাহেবা য়াঞ্চে চরিত্র’। ঠিক কী ভাবে সেই মরাঠি বই জোগাড় হল, তা আজ আর সবটা মনে নেই। কিছু একটা ভাবে জোগাড় হয়েছিল। তখন কলকাতায় ছিলেন ডক্টর প্রতুল গুপ্ত। তিনি মরাঠি জানতেন। তাঁর প্রেরণায়, সেই বই বগলে নিয়ে আমি গেলাম ভবানীপুরে মহারাষ্ট্র নিবাসে। এই ভাবে দৌড়োদৌড়ি শুরু হল। রোজ দুপুরে বই নিয়ে যাই মহারাষ্ট্র নিবাসে। তার পর মরাঠি যাঁদের মাতৃভাষা, তাঁদের সাহায্যে দ্রুতলিখন করে নিই, যেমন পারি। এই ভাবে, সাধ্যমত অনুবাদ করে নিই।
রানি লক্ষ্মীবাই গঙ্গাধর রাও-এর প্রথম পত্নী নন। গঙ্গাধর আগেও বিবাহ করেছিলেন। সেই স্ত্রীরও মৃত্যু হয়েছিল। বিবাহের পর ১৮৫১ সালে রানির একটি পুত্র হয়। এই সন্তানও তিন মাসের বেশি বাঁচেনি। গঙ্গাধর রাও মনে মনে খুবই ভেঙে পড়েন। ১৮৫৩ সাল নাগাদ তিনি শরীরে ও মনে খুব বিধ্বস্ত ছিলেন। তাঁর কোনও সন্তান হল না। যাঁর রাজ্য, তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে ব্রিটিশরা মৃত রাজাকে রাজ্যের অধিকার দিচ্ছিল না। রাজা যদি মৃত্যুশয্যায় কোনও বালককে দত্তক নিতেন, সেটাও ইংরেজরা মেনে নিত না। তবু গঙ্গাধর মৃত্যুশয্যায় আনন্দ নামক এক আত্মীয়-পুত্রকে দত্তক নিলেন। এই অনুষ্ঠানের সময় বুন্দেলখণ্ডের সহকারী রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেজর এলিসও উপস্থিত ছিলেন।
গঙ্গাধর রাও বা লক্ষ্মীবাই, কেউই ভাবতে পারেননি, গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ইংরেজ সরকার এই দত্তক গ্রহণের বিরোধিতা করবে। কিন্তু তাঁদের ভুল হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ঝাঁসি নিয়ে নিল এবং রানির কোনও যুক্তিই খাটল না। ঝাঁসি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন রানি। সেই জন্যই তত্‌কালীন ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে তাঁর বিরোধ। রানি ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়েন ও যুদ্ধে নিহত হন। আমি আমার সাধ্যমত তথ্য জোগাড় করি। আশ্চর্য লাগে এটাই ভেবে, যা নিয়ে লিখব ঠিক করেছি, তার কে-কী-কেন-কবে-কোথায় কিছুই সে দিন ঠিকমত না জেনেই, এক আশ্চর্য সাহস ও বিশ্বাস নিয়ে, শুধু বিষয়টার প্রতি ভালবাসা ও তাকে ফুটিয়ে তোলার জেদ সম্বল করে, স্বখাত সলিলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। কোনও মতে জোগাড় হল ছোট্ট একটা ক্যামেরা। সেটি নিয়ে রাতে আগ্রার ট্রেনে উঠে বসলাম। আমার একমাত্র পুত্র তখন ছোট। তাকে বাড়িতে রেখে, স্বামীর (বিজন ভট্টাচার্য) উত্‌সাহে ঝাঁপ দিলাম এই অভিযানে। আমার বড় মামা শচীন চৌধুরীও উত্‌সাহ জুগিয়েছিলেন খুব। বারংবার বলতেন, আমি যেন রানির একটি জীবনচরিত লিখি।
কলকাতা থেকে ঝাঁসি যাওয়ার সরাসরি ট্রেন তখন ছিল না। ব্রেক জার্নি করে পৌঁছেছিলাম সেই ছোট্ট শহরে। মনে পড়ছে, সেনাবিভাগের এক বাঙালি অফিসারের বাড়িতে উঠেছিলাম। ছোট শহর ঝাঁসি তন্নতন্ন করে দেখেছিলাম। রানির কেল্লা অবহেলিত অবস্থায়, শিবমন্দির, ফাঁসির মঞ্চ ভাঙাচোরা ও দুর্দশাগ্রস্ত। রানি যেখানে নিত্য পুজো করতে আসতেন, সেই মহালক্ষ্মী মন্দিরও তথৈবচ। ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছি, অথচ সরকারি নির্দেশ: কেল্লার ভিতরে ছবি তোলা বারণ। স্বাধীন ভারতের সেই ঝাঁসিতে রানির একটি মূর্তি ছাড়া অন্য কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই।
রানিকে শেষ অবধি খুঁজে পেলাম বৃদ্ধ টাঙাওয়ালা, কাঠকুটো জ্বালিয়ে-বসা কিষানি মেয়েদের মাঝে। তারা বলে, ‘রানি মরগেই ন হউনি, আভি তো জিন্দা হোউ।’ রানিকে লুকিয়ে রেখেছে বুন্দেলখণ্ডের পাথর আর মাটি। অভিমানিনী রানির পরাজয়ের লজ্জা লুকিয়ে রেখেছে জমিন...আমাদের মা। সরকারি ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রানিকে এক ভাবে দেখেছে, আর স্থানীয় গরিব মানুষেরা তাঁকে উপকথায় নিজেদের জীবনে বয়ে চলেছে।
তবে এই বই লেখার সময় সবচেয়ে অবাক ব্যাপার যা ঘটল, তা হল, রানির ভাইপো গোবিন্দ চিন্তামণি পাণ্ডের সঙ্গে সাক্ষাত্‌ ও বন্ধুত্ব হওয়া। ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে জানতাম না। রানির ভাইপো, সত্যিই রানি লক্ষ্মীবাইয়ের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলে গোবিন্দ চিন্তামণি পাণ্ডে। এঁর আত্মীয়া ছিলেন রানির বিমাতা। সেই সূত্রে ইনি রানির ব্যক্তি-পরিচয় ভালই জানতেন। যেমন, ‘রানি (ব্যক্তিজীবনে নিরামিষাশী) একটু অধিক পক্ব ঘি পছন্দ করতেন।’ রানি ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন, সে বিষয়ে অনেক কথাই তিনি বলতেন। ওঁর কাছেই জেনেছিলাম, রানির কপালে অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি উল্কির দাগ ছিল। রানির বিমাতা চিন্তাবাই তাঁর নাতনি দুর্গাকে কৌতুক করে মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘আয়, তোর কপালে উল্কি পরিয়ে দিই। বাই সাহেবার যেমন ছিল!’
একমাত্র চিন্তামণির কথাবার্তাতেই মনে হত, ঝাঁসির রানি এক জন চেনার মতো মানুষ কড়া পাকের ঘি পছন্দ করতেন, ঘোড়ার পিঠে ঘুরতেন! তাঁর কাছে আরও শুনেছিলাম, ১৯০৩ সালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির সময় লর্ড কার্জনকে দামোদর রাও চিঠিতে অনুরোধ করেছিলেন, সেখানে যদি রানির একটি প্রতিকৃতি থাকে! লর্ড কার্জন উত্‌সাহ দেখিয়ে ছবি পাঠিয়ে দিতে বলেন। তাঁর যুক্তি, রানির ছবি রাখা যেতে পারে, কিন্তু নানাসাহেবের নয়। সেই ছবি পাঠানো যায়নি, কার্জনের পরবর্তী কোনও বড়লাট এই নিয়ে উত্‌সাহ দেখাননি। দেখালে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেই থাকতে পারত রানির প্রামাণ্য তৈলচিত্র।
এই ভাবেই বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন ভাবে তথ্য জোগাড় করে তৈরি হল পাণ্ডুলিপি। পুরো পাণ্ডুলিপি দেখে দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার। সাগরময় ঘোষ আগ্রহ নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন সেই লেখা। অতঃপর ‘নিউ এজ’ প্রকাশনা থেকে বেরোল বই: ঝাঁসীর রাণী। সেটিই আমার লেখা প্রথম বই, তখনকার দিনে মূল্য ধার্য করা হয়েছিল ২০ টাকা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.