|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ২... |
লক্ষ থেকে শুরু |
শূন্য থেকে নয়। চাকরিতে ঢুকেই বাড়ি, গাড়ি। ফুর্তির ফোয়ারা।
সফল তরুণ-তরুণীর বদলে যাওয়া জীবনে মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। |
তিরিশের কোঠার মাঝামাঝি পৌঁছনোর আগেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুগুলো পাওয়া হয়ে গেল।
মোটা মাইনের চাকরি-বাড়ি-গাড়ি, বিনোদনের হাজার পসরাসাফল্যের প্রাথমিক শৃঙ্গগুলি জয়ের পর কী পড়ে থাকে, যা পাওয়ার টানে জীবনের বাকি পথ হাঁটা যায়?
মনে পড়ে যায়, প্রখ্যাত সমাজ-সাংবাদিক পি সাইনাথ তাঁর একটি লেখায় বলেছিলেন ‘৩০-৩৫-এ সব পাওয়া হয়ে গেল মানে ৪৫-এর মধ্যেই লোকটা মিডল-এজ ক্রাইসিসে ক্ষতবিক্ষত হবে।’ সত্যিই কি তাই?
তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও মানুষের সাফল্য আর নিরাপত্তার প্রধান সংজ্ঞা ছিল, একটা পেনশনশোভিত সরকারি চাকরি।
সেই চাকরি পেতেই ঘষ্টে-ঘষ্টে ছাব্বিশ-সাতাশ। মাইনে শুরু কমবেশি পাঁচ-সাত হাজার টাকা দিয়ে। তার পর একটু-একটু করে মাথা গোঁজার ঠাঁই, তাতে টুকটাক ইলেকট্রনিক হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস, মেয়ের বিয়ে বা ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা রাখা আর বড়জোর একটা গাড়ির মালিক হতে গিয়েই পঞ্চান্ন পার, চুলে পাক, বাত।
আর এখন?
প্রফেশনাল কোর্স পাশ করে তেইশ পেরোতে না পেরোতে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার কী তারও বেশি টাকার মাইনেতে কেরিয়ার শুরু। তখনও নিজের সংসার হয়নি। বাড়িতে প্রায় কিছুই দিতে লাগে না।
পঁয়ত্রিশেই তাঁরা ফি মাসে এত মাইনে পান যেটা এক সময় অনেকে ৬ মাসে পেতেন কি না সন্দেহ। বাজার দরের কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, এঁদের অনেকের হাতেই বাড়তি টাকা অনেকটাই। সঙ্গে রয়েছে ইএমআই-য়ের সুবিধা। চল্লিশের মধ্যে বাড়ি-গাড়ি বা অন্য সব বিনোদনের ‘বেসিক টার্গেট’ এঁরা তুমুল সাফল্যে জয় করে নিচ্ছেন তুলনায় অনেক সহজেই। কিন্তু তার পর? খেই হারিয়ে ফেলেছেন কি এঁদের অনেকেই?
“এখান থেকেই শুরু হয় ‘স্যাচুরেটেড পয়েন্ট’ বা সীমিত বিন্দুর খেলা। ‘সব পেয়েছির আসরে’ দাঁড়িয়ে সব কেমন গুলিয়ে যাওয়ার পালা”, বলছিলেন কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থার মার্কেটিং ম্যানেজার শোভন রায়চৌধুরী। |
|
৩৩ বছর বয়সে তাঁর পে-প্যাকেটে মাসে আসে পঁচাশি হাজার টাকা। লাইফস্টাইল গ্রাফ রোজই বাড়ছে তেড়েফুঁড়ে। কিন্তু প্রতিদিনের ওই ১২-১৩ ঘণ্টার কাজ, মিটিং, অফিস পলিটিক্স, প্রায়ই ট্যুরে দেশ-বিদেশ ছুটে বেড়ানো, পরিবারকে সময় দিতে না-পারার অপরাধবোধ মিলিয়ে তিনি এখন বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ। “সামাজিক জীবনটাই যদি না থাকে, এত সবের কী মানে,” বলছিলেন তিনি।
শোভনের খুব ইচ্ছা করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পড়ানো শুরু করতে, পাড়ার ঠেকে চুটিয়ে আড্ডা মারতে, গিটার শিখতে। কিন্তু এমন ঘূর্ণিপাকে ফেঁসেছেন, বন বন করে তাতে পাক খাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও উপায় দেখছেন না।
আফশোস করে বললেন, “প্রচুর টাকা লোন নিয়ে বাবা-মা পড়াশোনা করিয়েছেন। তাঁদের স্বপ্ন ছিল ছেলে বিশাল চাকরি করবে, রোজগার করবে। এখন চাকরি ছাড়লে ওঁদের মুখ দেখানো মুশকিল। তা ছাড়া, বাড়ি-গাড়ির ইএমআই চলছে। চাকরি ছাড়ব কী করে?”
‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা রুচিরা গোস্বামী। কথায়-কথায় তিনি জানাচ্ছিলেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে অল্প বয়সে সুপ্রতিষ্ঠিত হন অনেকেই। মুদ্রার উল্টো পিঠটা কিন্তু বেশ পানসে। জীবনে দ্রুত তাঁরা এত কিছু পেয়ে যাচ্ছেন, যে নতুন কোনও কিছুতে ‘অবাক হওয়া’র আনন্দ, চমক তাঁদের মরে ভূত। জীবনে উৎসাহ নেই। উত্তেজনা? আবেগ? তাও নেই। দিনযাপনটা তাঁদের কাছে যেন একঘেয়ে, বিরক্তিকর এক জড়বস্তু।
সল্টলেকের একটি ম্যানেজমেন্ট স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে থাকা সম্রাট পান্থীর অভিজ্ঞতা শুনুন।
বলছিলেন, “অল্পবয়সি প্রতিষ্ঠিতদের একাংশের হাতে প্রচুর টাকা, অথচ খরচের সময় নেই। এদিকে জীবনকে চেটেপুটে উপভোগ করতে বিশ্বাসী এঁদের বড়সড় একটা অংশ সঞ্চয়েরও ধার ধারেন না। ফলে বিপুল টাকা গলে যাচ্ছে ‘আনপ্ল্যান্ড’ খাতে। সে উইক-এন্ড পার্টিই হোক, কী বছরে বিলাসবহুল বিদেশ-ট্রিপেই হোক।” পাশাপাশি মারাত্মক প্রতিযোগিতা এবং মন্দার যুগে মনের অন্দরে চাকরি হারানোর শঙ্কা এঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দিনের পর দিন।
চেন্নাইয়ের একটি এজেন্সি থেকে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট’-এর অনেক ছাত্রছাত্রীর প্লেসমেন্ট হয়। সেখানে কর্মরত এক বাঙালি কাউন্সেলর বললেন, “কাজের অফার নিয়ে এঁদের ফোন করলে প্রথমে এঁরা জব প্রোফাইল জানতে চান না! শুধু স্যালারি জিজ্ঞাসা করেন! মনোমতো টাকা হলে অপছন্দের কাজেও আপত্তি নেই। জব স্যাটিসফ্যাকশনের পরোয়া করেন না এঁরা।”
সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশ এঁদের উৎপটাং জীবনের কারণ হিসেবে দু-একটি কথা প্রায়ই বলছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, এঁরা আদ্যোপান্ত ভোগবাদে বিশ্বাসী। পরিচিতদের থেকে বেশি সফল হতে হবে, বেশি মাইনে পেতে হবে, এটাই অধিকাংশর টার্গেট। কোন রোস্তোরাঁর কখন কাবাব ফেস্টিভ্যাল, না ক্র্যাব থেকে শুরু করে কোন আউটলেটে কী কিনলে আখেরে লাভ, কোন এয়ারলাইনস কখন কী অফার দিচ্ছে, সব এঁদের নখদর্পণে। নতুন কেনা দামি গাড়ি কি মডিউলার কিচেন বা শহরের বাইরে কেনা ঝাঁ চকচকে ডুপ্লের ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে এঁদের সুখ। একটা ফ্ল্যাট হয়ে গেলে আরেকটা, একটা গাড়ি হলে বছর ঘুরতেই তার থেকেও ভাল গাড়ি, এই ভাবে এঁদের টার্গেট বদলে যেতে থাকে প্রতি পলে। আর টার্গেটটাই ওঁদের অনেকের জীবনে ‘ভিসিয়াস সার্কেল’ বা সর্বনাশা বৃত্তের জন্ম দেয়। হারিয়ে যায় জীবনের মৌলিক ফোকাসটাই।
আবার এর ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে এঁদের আরেক দল। সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক প্রশান্ত রায় বললেন তাঁদের কথা, “এঁদের জীবনেও ‘টার্গেট শিফট’ হয়, কিন্তু সেটা অন্য ভাবে। এঁরা ৪৫-৪৯ বছর পর্যন্ত চাকরি করেন। যত পারেন টাকা জমিয়ে নেন, বাড়ি-গাড়ি করে ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে ফেলেন। তার পর চাকরি ছেড়ে, ঝাড়া হাত-পায়ে জীবনটা নিজের মতো করে কাটান।”
এঁদের কেউ বহুজাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে যাচ্ছেন, কেউ হচ্ছেন ছবির পরিচালক, কেউ বা গায়ক। কেউ আবার যুক্ত হচ্ছেন সমাজসেবামূলক কাজে কিংবা কোনও ফ্যাকাল্টিতে। অনেকে আবার নিজের কনসাল্টেন্সি বা ব্যবসা খুলে বসেছেন, এমন উদাহরণও বিরল নয়।
তার জন্য হয়তো বা কিছুটা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। যতটা সচ্ছলতায় ছিলেন ততটা হচ্ছে না। কিন্তু ‘কোয়ালিটি লাইফ’-কে গুরুত্ব দিয়ে এঁরা চাকরিতে দাঁড়ি টানছেন। ফলে দেরিতে হলেও জীবনের ‘উল্লাস’ তাঁরা ফিরে পেতে চাইছেন এভাবেই।
কারও আবার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভাল। ফলে চাকরি ছেড়েও একেবারে জলে পড়ে যাচ্ছেন না। আর এদের বেশির ভাগই পড়াশোনায় এবং কাজে মোটামুটি দক্ষ, তাই চাকরি ছাড়ার অভিযান ব্যর্থ হলে ফের পুরনো কাজের জগতে ফেরার একটা সুযোগ এঁদের থেকে যায়। সেই আত্মবিশ্বাস থেকে অনেকে ঝুঁকিটা নিচ্ছেন।
আমহার্স্ট্র স্ট্রিটের দুই বন্ধু সোহম ও বীরেন্দ্র আইআইটি-র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাইক ট্যুর করানোর ব্যবসা করেন, মুকুন্দপুরের সীমা পোদ্দার কালিম্পং-এ নিজের অর্কিড আর ফুলের নার্সারি খুলেছেন, দুর্গাপুরের পারমিতা সরকার ব্যবসায়িক সংস্থার হাইপ্রোফাইল কাজ ছেড়ে এখন বুটিক কাম কফি শপ চালান।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে দিল্লির একটি ‘শপার্স রিসার্চ কনসাল্টেন্সি’-তে প্রচুর টাকা মাইনের চাকরি পান বৌবাজারের সৌম্য বসাক। এক বছরের কর্মজীবনে প্রায় ৭০ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল বিমানে। নিজেকে যন্ত্র বলে মনে হচ্ছিল সৌম্য-র। মাঝেমধ্যে তাই প্লেনে চেপেই কলকাতায় চলে আসতেন শুধু পাড়ায় আড্ডা দেবেন বলে। তার পর দুম করে দিলেন চাকরি ছেড়ে। এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে গবেষণা করছেন। বললেন, “সাফল্যের সংজ্ঞা সবার কাছে এক নয়। জীবনের লক্ষ্যটাও আলাদা। গোলমালটা হয়ে যায় সেই ভারসাম্যটা হারালেই। শপার্স রিসার্চের সময় ভোগবাদের চরম রূপ আমি দেখে নিয়েছি। ওই মোহ আর আমার নেই। জীবনের যেন একটা মানে থাকে। গভীরতা থাকে। এখন সেই হারিয়ে যাওয়া রিদমটা আমি ফিরে পেয়েছি।”
সল্টলেকের এক বেসরকারি সংস্থার এক তরুণী ক্যানসার বিশেষজ্ঞের একটা সময় টার্গেট ছিল এমডি করা। তার পর বিদেশে ফেলোশিপ। “সে সব হয়ে যাওয়ার পর এখন ঠিক করেছি, কাজ আর পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলব,” বললেন সেই তরুণী। এখন বাচ্চাদের পড়ানো, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখা তাঁর প্রায়োরিটি। ঠিক করেছেন, ৪৫-এর পর আর চাকরি করবেন না।
আটত্রিশ বছরে এক নামী সংস্থার এরিয়া ম্যানেজার সুদক্ষিণা কর পুরকায়স্থ চাকরি ছাড়বেন না। তবে ঠিকঠাক ভাবে জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার অক্সিজেন জোগাতে স্কুলের পুরনো বন্ধুদের নিয়ে একটা জোট তৈরি করেছেন। সবাই মিলে এঁরা হঠাৎ নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়েন মাঝে মধ্যেই। পথশিশুদের স্কুলও খুলেছেন একটা। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সপ্তাহে এক দিন মোবাইল হেল্থ ইউনিট নিয়ে যান। কোনও হল ভাড়া করে বছরে একটা নাটক করেন বন্ধুরা মিলে। এতে যেমন অল্পবিস্তর অর্থ আসে, তেমন মনের খোরাকও মেটে, মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা পূরণ হয়। এক ধরনের তৃপ্তি আসে মনে। জীবনটা দিব্যি ঝিলমিল করে।
শুনতে-শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেলুলয়েডের পর্দায় দেখা গল্প। ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা।’ জীবন একবারই আসে। তাতে ডুব দাও। প্রাণখুলে বাঁচো। মধ্য তিরিশের মধ্যে গতানুগতিক প্রতিষ্ঠার হার্ডল পেরিয়ে জীবনকে কে, কী ভাবে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারছে সেটাই হল আসল কথা।
জীবনকে আলিঙ্গন করতে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দ্রুত সফল অনেক নবীনই। |
|
|
|
|
|