|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১... |
হারানো সুর |
মাউথ অর্গ্যান থেকে পাখোয়াজ। পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান, কী এস্রাজ। যন্ত্রগুলোর সলিল সমাধি হয়ে গেল? স্মৃতিকাতর শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। |
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ষাটের দশকের মধ্যিখান অবধি সদ্যযুবতীদের কাছে সব চেয়ে নজরকাড়া আর জ্যাঠা-খুড়োদের কাছে সব চেয়ে চক্ষুশূল ছিল সেই সব উঠতি বয়সি ছেলে যারা মাউথ অর্গ্যান বাজাতে বাজাতে রাস্তা ধরে যেত। আর সেই বাজনায় যদি ‘সোলভা সাল’ ছবির দেব আনন্দের লিপে হেমন্তর ‘হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা’ থাকল, কী ‘ডক্টর জিভাগো’র থিম টিউন ‘সামহোয়্যার মাই লভ দেয়ার উইল বি সঙস্ টু সিং’, তাহলে তো মাউথ অর্গ্যান তখন শ্যামের বাঁশি।
যে ছোকরারা জার্মানির ‘হর্নার’-এর দেখনদারি যন্ত্রে ভ্যাম্প নিয়ে বাজনা ধরত তাদের, ঈর্ষাকাতরের দল ‘দ্যাখ কীরম হিড়িক মারছে, দ্যাখ’ বলে ওড়াবার চেষ্টা করত। কাজে আসত না। যাদের পটার তারা পটেই যেত। যা দেখে যাদের একটা ফুঁ-এও সুর লাগত না তারাও বুক বা হিপ পকেটে একটা করে মাউথ অর্গ্যান রাখা ধরেছিল।
সেই যে ’৫৭ কী ’৫৮ সালে রেলের কামরায় মাউথ অর্গ্যানে ঠোঁট রগড়ে ‘হ্যায় অপনা দিল’ করে ছবির ষোড়শীকে (ওয়াহিদা) বাগে আনলেন দেব আনন্দ, তার পরে পরেই যন্ত্রটা আগুনের মতো ছড়াল।
কে আর জানত তৎকালে যে, এস ডি বর্মনের সুর করা ছবিটার ওই তুরুপের তাসটি ছিল পুত্র রাহুল দেবের অবদান। আওয়াজ ছাড়াও যন্ত্রটা বাজাবার ভঙ্গির মধ্যেও একটা সেক্সি ব্যাপার ছিল। প্রিয়ার ঠোঁটে যেন ঠোঁট বোলাচ্ছে প্রিয়। একটা চুমু চুমু ভাব।
মাউথ অর্গ্যান যে কী ছিল কলকাতার জীবনে তা আজ লিখে বোঝাতে হচ্ছে, আর তা বোঝানো কারও কম্মো নয়।
সিন্থেসাইজার নামক দশকর্মভাণ্ডারটি যখন বাজারে চড়াও হয়নি, তখন পিয়ানো, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান, অর্গ্যান, মাউথ অর্গ্যান, বেহালা, স্যাক্সোফোন, আড়বাঁশি, এস্রাজ, চেলো বা হাওয়াইয়ান গিটারের কী যে মেজাজ ধরা ছিল বাঙালি জীবনে সে বর্ণনার ভাষা আমার নেই। পারলে পারতেন হয়তো ‘স্মৃতির অতলে’-র রচনাকার অমিয়নাথ সান্যাল মশাই। কিংবা হয়তো, ‘কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গি’র কুমারপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। কিংবা, হয়তো তাঁরাও নন। কারণ উস্তাদ বিলায়েত খান যেমন এক দিন বলেছিলেন, “একটা সুরের আন্দাজকে শুধু গেয়েই দেখানো যায়, লিখে বোঝানো যাবে না।’’ এই কথাটা অবশ্য আগেই বলে রেখেছিলেন তাঁর বইয়ে অমিয়বাবুও।
মাউথ অর্গ্যান যে কলকাতার লাইফস্টাইল থেকে সরে গেল তার তিনটি কারণ দেখতে পাই। |
|
এক, বাঙালি গার্জেনরা এ যন্ত্র শেখায় কোনও উৎসাহ দিতেন না। দুই, হিন্দি ছবিতেও এর অনস্ক্রিন প্রেজেন্স আটকে থাকছিল প্রধানত আউটডোর সিকোয়েন্সে। পার্টির দৃশ্যের গানবাজনায় পিয়ানো তো বরাবরই ছিল, সেখানে একটু একটু করে জায়গা করে নিল পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান। আর তিরিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে যখন রোম্যান্টিক দৃশ্য ও গানের ওই বাড়বাড়ন্ত সেখানেও কোল পেলে না মাউথ অর্গ্যান।
কে জানে, বাঙালি হয়তো সেভাবে কোনও দিনই মূল্য বোঝেনি মাউথ অর্গ্যানের!
অথচ এ দৃশ্যও রাতের পর রাত জুড়ে দেখা গেছে শহরের শীতের জলসায়। পারতপক্ষে এক ওয়ান ম্যান অর্কেস্ট্রা ভি বালসারা সাহেব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাউথ অর্গ্যান, মাউথ হার্মনিকা ও পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানে লতার ‘সাত ভাই চম্পা’, হেমন্তের ‘এই রাত তোমার আমার’ কী মুকেশের ‘বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহি’ বাজিয়ে টানা দু’আড়াই ঘণ্টা জমিয়ে রাখছেন শ্রোতাকে।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধ। রাজ কপূরের ‘সঙ্গম’ ছবি সদ্য মুক্তি পেয়েছে শহরে, কিন্তু তার আগেই এর ধুন্ধুমার বাঁধানো গানগুলো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে বিনাকা গীতমালার দাক্ষিণ্যে। তখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ইস্কুলের ছাত্রদের অভিজ্ঞতা বলি।
রোজ বিকেলে খেলার মাঠে যাবার পথে পা আটকে যায় ওখানকার কলেজপড়ুয়াদের ছাত্রাবাস ব্রহ্মানন্দ ভবনের পাশে এসে। কে যেন বাড়ির দোতলায় খোলা জানালার পাশে বসে নিপুণ দক্ষতায় বাজিয়ে যায় ‘সঙ্গম’-এর প্রাণ উদ্বেল করা ‘ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পঢ়কর’। মাঠে যাওয়া হয় না, ওখানেই থমকে থাকে ছাত্রদের কেউ না কেউ।
এক দিন শোনা গেল বাজছে মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’, সঙ্গে সঙ্গে গাওয়াও হচ্ছে গানটা। আর থাকতে না পেরে এক ছাত্র উপরে উঠে গেল কলেজের দাদাটিকে দেখতে, আর পেয়ে গেল এক সুপুরুষ, দৃষ্টিহীন যুবককে। এর কয়েক বছরের মধ্যে সব বাঙালি যাঁকে চিনে ফেলেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী স্বপন গুপ্ত হিসেবে।
রবিঠাকুরের গানে স্বপন গুপ্তর স্মরণীয় সাফল্যের পিছনে কী ভাবেই যেন এক সময় হারিয়ে গেল ওঁর পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান আর পিয়ানোবাদনের কুদরৎ রঙ্গি-বিরঙ্গি। বাংলা করলে, ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার রং-বেরং।
পিয়ানোয় অপূর্ব দখল ছিল বালসারার। ভি জি যোগের সঙ্গে মঞ্চে বসে যুগলবন্দি করেছেন পিয়ানো ও বেহালার। অথচ জীবনের গোধূলি লগ্নে এসে দু’জনকেই দেখতে হল ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে শহরের সঙ্গীতজীবনে ওই যন্ত্র দু’টিও প্রায় থমকে রয়েছে কোথায় যেন। যে কারণে এক অদ্ভুত আবেদন করেছিলেন মৃত্যুর কয়েক দিন আগে। এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকার গানের সঙ্গে শুধু পিয়ানো দিয়ে সঙ্গত করবেন। সেই সিডি ‘এক পিয়ানো একটি কণ্ঠ’ রেকর্ড করার ন’দিনের মাথায় তিনি প্রয়াত হন।
বয়স্করা না হয় মাউথ অর্গ্যান বাজানোকে ফক্কড়ি বলতেন, কিন্তু পিয়ানো তো ছিল বাঙালি আভিজাত্যের এক নির্ভুল বিজ্ঞাপন। ছড়ানো বিছোনো ড্রয়িংরুম থাকবে, অথচ এক কোণে একটা আপরাইট পিয়ানো বসানো থাকবে না, এ তো রীতিমতো ‘ফো পা’, পদস্খলন। বাড়িতে বাড়িতে পিয়ানো টিউটরেরও আনাগোনা ছিল। যারা আরও দম নিয়ে শিখতে চায় তারা নাম লেখাত ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিকে। হিন্দি সিনেমায় তখন প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদের সূচনায় প্রেমিককে একটা গান গাইতেই হত পিয়ানো বাজিয়ে। যার এক আইকনিক দৃশ্যায়ন শিবরঞ্জনী রাগে রাজ কপূরের ঠোঁটে ‘দোস্ত দোস্ত ন রহা’, ‘সঙ্গম’ ছবিতে।
উত্তমকুমার অভিনীত ‘লাল পাথর’ ছবিতে নির্মলকুমারকে গানের শিক্ষক করে আনা হয়েছিল নায়কের স্ত্রীর জন্য। আর সে পরিস্থিতি জটিল করেছিল কলাবতী রাগিণীতে শ্রাবণী বসুকে ‘ডেকোনা মোরে ডেকোনা গো আর’ শিখিয়ে। অশরীরীর মোকাবিলা করতে বিশ্বজিৎ ‘কুহেলী’ ছবিতে পিয়ানো বাজিয়েছেন কবিগুরুর ‘তুমি রবে নীরবে’-র সঙ্গে।
এ সবই ষাটের দশকে ছায়াছবির ছবি। তখনও বছর জুড়ে বিনামূল্যে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল কনসার্ট হচ্ছে লোরেটো হাউজে। পিট সিগার তাঁর গিটার নিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছেন মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে। খবর আসছে আমেরিকায় দেদার নাম করছেন তরুণ ভারতীয় কন্ডাক্টর জুবিন মেহতা। এবং সে দেশে সেতার, গঞ্জিকা আর যোগী-ধরা নিয়ে রসিয়ে ছবি হচ্ছে ‘দ্য গুরু’।
কলকাতার ঘরে ঘরে কিন্তু দশক শেষের ছবিটা একটু অন্য রকম। নামী শিক্ষিকা ও পিয়ানিস্ট লোলিতা মায়াদাস ঠাট্টা করে তখনকার নামী ইংরেজি দৈনিকের সাময়িকীতে লিখলেন কী ভাবে কনসার্টে হাজির না হয়েও কাগজে রিভিউ রেবিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাজানো পিসের নামের জায়গায় না-বাজানো পিসের নাম।
লোলিতা আর ওঁর স্বামী, পিয়ানিস্ট অজিম লুইস মারাদাস, এক দিন ওঁদের টিভোলি কোর্টের ফ্ল্যাটে রেডিওগ্রামে রেকর্ড বাজিয়ে এক পরিচিতকে শুনিয়েছিলেন রাভেল-এর সমুদ্র নিয়ে আর রুসেল-এর মরুভূমি নিয়ে কম্পোজিশন। রাভেল-এর ‘ওসেয়ান’ বা সমুদ্রে সুর দিয়ে যে ভাবে ঢেউ তোলা ও দেখানো হচ্ছে সেখানে এসে লোলিতা উত্তেজিত ভাবে বলছিলেন, ‘বাজনা শিখলে এ জিনিসই যতটা সম্ভব করে দেখানোর উচ্চাশা থাকা চাই। কই সে সব?’ ‘ক্যে সেরা সেরা’ খুব সুরে বাজানোটাও একটা অ্যাচিভমেন্ট, কিন্তু ওখানেই থামতে হবে কেন?’
ওঁর কথাতেই টের পাওয়া যায় পিয়ানো শিখিয়ে পূর্বের সেই চাঞ্চল্য থিমিয়ে এসেছে। এর কিছু দিন পরই ওঁরা স্থায়ী ভাবে বিদেশে বসবাস শুরু করেন।
পিয়ানো বাজিয়েই যাঁর কম্পোজিশন আসত মাথায় সেই সলিল চৌধুরী কিন্তু দিব্যি লড়ে যেতেন সিন্থেসাইজারের হয়ে। বলতেন, ‘‘মোৎজার্ট কি ওঁর সময়কার কোনও যন্ত্রকে বাদ রেখেছিলেন রচনা থেকে? এ সব যন্ত্র পেলেও ওঁর আরও নতুন ধরনের পিস আসত।’’
দুঃখের বিষয়, এই সলিল চৌধুরিই জীবনের শেষ দশটা বছর ওঁর ‘ক্যালকাটা’ শীর্ষক সিম্ফনি করব করব করেও মঞ্চস্থ করে যেতে পারেননি। করতে পারলে বেহালা, চেলো বা ইংলিশ ফ্লুটের কী চেহারা, কী প্রয়োগ আমরা দেখতে পেতাম তা আজ কল্পনাতেও আনতে পারছি না।
মনে পড়ছে ১৯৭৭-এ যখন ইংল্যান্ড যাচ্ছেন রবিশঙ্করের এক অনুরাগী, তাঁর স্মৃতিচারণা নিয়ে কাজ করতে, তখন শিল্পী অন্নদা মুন্সী তাঁকে ক’খানা এলপি কভারের ডিজাইন (সত্যিই অপূর্ব) দিলেন ইহুদি মেনুহিনকে দেবার জন্য। আর রবিশঙ্করের জন্য উপহার? একটা ক্যাসেটে রেকর্ড করা ওঁর এবং পুত্র ম্যান্টো-র (যাকে স্নেহ করে ডাকতেন মোৎজার্ট) দ্বৈত বেহালায় বাজানো মোৎজার্টের ‘আইনা ক্লাইনা নাখটম্যুজিক’।
মেনুহিন মুন্সীদা’র চারটে স্লিভ ডিজাইন পেয়ে চমৎকার একটা চিঠি লিখেছিলেন ওঁকে, আর রবিশঙ্কর তো ক্যাসেট শুনে অবাক হয়ে বলছিলেন ‘‘নিজে নিজে শিক্ষা করে মোৎজার্ট বাজাচ্ছেন ওঁরা? বেঁচে থাক কলকাতা!’’ কলকাতা আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরও বেঁচে আছে যেমন-তেমন, তবে বাঙালির বেহালা, এস্রাজ, পিয়ানো কী ভাবে আছে ভেবে শঙ্কা হচ্ছে। আব্রাহাম মজুমদার ও তাঁর কিছু শিষ্য, ভায়োলিন ব্রাদার্স ও দেবজ্যোতি মিশ্র বেহালার চল ধরে রাখছেন, স্প্যানিশ গিটার ছাড়াও কবীর সুমন সুযোগ পেলেই ফিরে আসেন পিয়ানোর কী-বোর্ডে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের রণবীর রায়ের অকাল মৃত্যুর পর রাগচর্চায় এস্রাজকে ধরে রাখার মতো চর্চা বিশেষ চোখে পড়ে না।
আজও চোখের সামনে ভাসে ১৯৭১-এ রবীন্দ্র সদনে কলাসঙ্গমের সান্ধ্য আসরে বেগম আখতারের অনুষ্ঠানের আগে এস্রাজ নিয়ে বসছেন তরুণ রণবীর। সেদিন ওঁর বাজানো শ্যামকল্যাণ আজও কানে ছেয়ে আছে।
আর আজ ক’জন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীই বা সঙ্গতে এস্রাজ রাখতে পারছেন? বা চাইছেনও?
প্রথমত, আসরে এস্রাজ সঙ্গতে গাওয়ার গানই বা ক’জন গাইতেন? সব গানই দৌড়চ্ছে সিন্থেসাইজারের রকমারি চালে। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধ্রুপদাঙ্গ গান এড়িয়ে আসরের আইটেম ঠিক হচ্ছে বলে এক কালে বাঙালি হৃদয়ে আনন্দের ঝড় তোলা পাখোয়াজ যন্ত্রটিও ক্রমাবসন্ন। মোহন সিংহ ও কতিপয় গায়িকা ভিন্ন খুব কেউ আর বিপ্লব মণ্ডলের পাখোয়াজের প্রয়োজন বোধ করেন না।
মঞ্চে এস্রাজহীন রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে দেখলে কেবলই স্মরণে আসে ওই যন্ত্র বাজিয়ে কী অপরূপ তালিম দিচ্ছেন সঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার। এস্রাজকে ওঁর কণ্ঠ করেছিলেন, সেই কণ্ঠ রোপণ করেছিলেন রাজেশ্বরী দত্তের গানে। শেষ দিকে প্রায়ান্ধ শৈলজদা এস্রাজ দিয়ে গান বলছেন দেখে কারও কারও একটা সিনেমার দৃশ্য মনে আসত।
দৃশ্যটা ফেদেরিকো ফেল্লিনির ১৯৭৩ সালের ছবি ‘আমারকর্দ’-এর। সেখানে গ্রামের অন্ধ বৃদ্ধ পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানে ফেল্লিনির রিমিনি গ্রামের যেন মর্মবেদনাই শুনিয়ে যান অবিরত। উৎসবশেষে সবাই যখন যে যার ডেরায় ফিরেছে, বৃদ্ধ তখনও রাস্তার মোড়ে একটা টুলে বসে যন্ত্রে বেলো করে আর রিড-এ আঙুল বুলিয়ে হৃদয়ের সব কথা উজাড় করে যান।
সুনীলদার (গঙ্গোপাধ্যায়) ‘আমারকর্দ’ ছবিটিকে ওঁর জীবনের এক প্রিয়তম অভিজ্ঞতা মনে করতেন। আর তার দু’টি স্মরণীয়তম দৃশ্যের একটি ছিল কিশোর নায়কের বাবা রাতে জাহাজে বসে তারকাখচিত আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলছেন, ‘আমার খুব জানার ইচ্ছে কে ওই আকাশে এই তারাগুলো সাজিয়েছে!’অন্য দৃশ্যটি পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান নিয়ে বসা বৃদ্ধ। যখনকার কথা এসব তখনও মধ্য কলকাতার একটি রেস্তোরাঁর দোরগোড়ায় এক বয়স্ক ভদ্রলোক অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য স্প্যানিশ গিটারে বিলিতি রোম্যান্টিক পপ গান বাজাতেন। তার মধ্যে অবধারিত একটি সুরও থাকত মের্লিনা মের্নুরির (পরে কনি ফ্রান্সিসও গাইলেন) ‘নেভার অন আ সানডে’।
গানটি মূলত যে গ্রিক এবং বিখ্যাত কম্পোজার হাজিদাকিস-এর রচনা তা জানা গিয়েছিল পরে। বস্তুত ১৯৬৪-৬৫তে আরেক মহান গ্রিক কম্পোজার মিকিস থিওদোরাফিস-এর আশ্চর্য সুরারোপের ছবি ‘জোরবা দ্য গ্রিক’ দেখে অনেকেই তো প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ভক্তদের অনেকেই আতিপাতি করে খুঁজে বেড়িয়েছেন ছবিতে ব্যবহৃত বুজুকি যন্ত্রটির অন্য কিছু রেকর্ড। সম্ভবত কেউই পাননি।
১৯৮০-তে আথেন্সে গিয়ে এক রসিক আবিষ্কার করেন শহরটা বুজুকি-বুজুকিতে ছয়লাপ। আর সশরীরে তাঁর পাহাড়চুড়োর বাড়িতে যান স্বয়ং থিওদোরাকিসকে। এ যেন তানপুরা খুঁজতে গিয়ে তানসেনকে পাওয়া। কী অনুরাগ ভদ্রলোকের বুজুকি যন্ত্রটির প্রতি! থিওদোরাকিস তাঁকে বলেন যে, আথেন্সের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের চেয়ে কিছু কম মূল্যবান নয় এই জলতরঙ্গ গোছের লৌকিক যন্ত্রটি। যা গ্রিকরা কখনও ধ্বংস হতে দেবে না। কারণ ওতে ধরা আছে গ্রিকদের কলিজার আওয়াজ।
আড়বাঁশি আর বাংলা ঢোলে তো বাঙালির শ্বাস আর চাপড় বাঁধা। তাতে বাঁশি আর ঢোল কি রাশি রাশি ঠোঁট আর কোল পেল?
পান্নালাল ঘোষের রেকর্ড বহুত ঢুড়লে হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু বাঁশি, ঢোল আর এস্রাজ শেখানোর মাস্টার পাওয়া যাবে? চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও বাঙালি ছোকরার হাতে একখান বাঁশি পড়লে পাঁচ-দশ দিন ধরে সমানে ফুঁ-ফাঁ, ফুঁ-ফাঁ করে একটা সুর কিন্তু তা থেকে বার করেই ছাড়ত। ‘অপুর সংসার’-এর অপুর মতো বাঙালি যুবার আরামের ব্যায়াম ছিল বাঁশি।
আজ তাদের মনের অলিন্দ ও জানালা, বুদ্ধির ব্যায়ামাগার হয়েছে টিভি, আবার কে! কোনও বাচ্চা মনের আনন্দে বাঁশি বাজায় শুনলে পড়শিজনের প্রথম প্রশ্নই হবে, ‘কার কাছে শেখে?’ যখন জবাবটা এল, ‘নিজেই যা পারে করে’, তখন অভিব্যক্তিটা বদলে হয়, ‘অ!’
এক সময়ে খুব মন খারাপ হত যে বাঙালির নিজস্ব কিছু রাগ আছে বলে শুনেছি কিন্তু কারও গায়নে, বাদনে পাইনি। যেমন বঙ্গালি ভাটিয়ার, বঙ্গালভৈরব বা বঙ্গাল। সময় পার হতে হতে খেয়াল হল বাঙালির প্রিয় যন্ত্রগুলোও তো আইফোন, আইপ্যাড, অক্টোপ্যাড, ড্রাম, কঙ্গো, বঙ্গোর দাপটে কোথায় যেন কাঁথামুড়ি দিয়ে কালাতিপাত করছে। তেমন একটি যন্ত্রের কথাও মনে আসছে। অনেক বাঙালি ছোকরাই প্রথম মাইনের টাকায় এরকম একটা যন্ত্র কিনে ফেলত। হয়তো টাইমপাস, তবু কিনত। যন্ত্রটির নাম ম্যান্ডোলিন।
রবিশঙ্করের সঙ্গে যেদিন দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মন্দিরে গিয়েছিলাম, উনি রামকৃষ্ণদেবের ঘরের পাশে বসা বিক্রেতার কাছ থেকে দু’টো ক্যাসেট কিনে উপহার করেছিলেন। একটা শুভলক্ষ্মীর গাওয়া ‘ভেঙ্কটেশ সুপ্রভাতম’ আর অন্যটি সদ্য আবির্ভূত বিস্ময়বালক ইউ শঙ্করের ম্যান্ডোলিনে হংসধ্বনি।
অ্যাদ্দিনে ইউ শঙ্কর বিরাট নামকরা মায়েস্ত্রো হয়েছেন কিন্তু কলকাতায় কে যে আর ম্যান্ডোলিন বাজাচ্ছেন কেউ জানে না। |
অলংকরণ: শেখর রায়।
|
|
|
|
|
|