অবসরের পরেও ছাত্রীদের আবদারেই রোজ স্কুলে
র দুপুরে বইখাতা বগলে সটান দিদিমনির বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিল নবম-দশম শ্রেণির একদল ছাত্রী। তাদের আবদার, ‘‘আপনাকে স্কুলে এসে আবার পড়াতে হবে। নাহলে আমরা এখান থেকে কোথাও যাব না।” ছাত্রীদের নাছোড়বান্দা আবদারে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত দিদিমনি পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। শেষমেশ অবশ্য কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই অবসরের পরেও ‘অবসরহীন’ জীবনটাই বেছে নিলেন কেতুগ্রামের শ্রীগোপালপুর ললিতাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা প্রতিমা ভদ্র।
বরাবরই স্কুলের প্রয়োজনে, ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনে সবার আগে এগিয়ে আসেন অঙ্ক ও ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষিকা প্রতিমাদেবী। বছর সাতেক আগেও তিল তিল করে টাকা জমিয়ে ওই স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য দু’লক্ষ টাকা খরচ করে শৌচাগার-সহ ৭৫০ বর্গফুটের একটা বড় ঘর তৈরি করে দেন তিনি। এ বারও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা অপ্রতুল হওয়ায় অবসরের পরেও এক কথায় পড়াতে রাজি হয়ে যান। তাঁর কথায়, “স্কুল আমার কাছে মন্দির। আর শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় বরং নেশা। তাই সে দিন ছাত্রীদের আবদার উপেক্ষা করতে পারিনি।” এখনও নিয়ম করে সপ্তাহে ২০টা ক্লাস নেন প্রতিমাদেবী।
ক্লাসে ব্যস্ত প্রতিমাদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
ললিতাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলের জন্মলগ্ন থেকেই সঙ্গে রয়েছে প্রতিমাদেবী। কাটোয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন এই স্কুলে। পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর করেন। টানা ৪০ বছর পড়ানোর পরে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে অবসর নেন তিনি। তার কয়েকদিন পরেই এক দুপুরে হাজির হয় নবম ও দশম শ্রেণির অপর্ণা, শম্পা, প্রীতিরা। তারা জানায়, দিদি চলে যাওয়ার পরে আমাদের ওই ক্লাসগুলি ফাঁকা যাচ্ছিল। তাই দিদির কাছে গিয়ে বলি, ‘আপনাকে ফের পড়াতে হবে। নাহলে আপনার বাড়ি থেকে যাব না।’ এরপরেই প্রতিমাদেবী ছাত্রীদের চকোলেট দিয়ে তাদের আবদারে সম্মতি দেন। ওই স্কুলেরই প্রীতি ঘোষ, স্নেহলতা সাহারা বলে, “দিদিমনি ভৌত বিজ্ঞান আর অঙ্ক এমন ভাবে খেলাচ্ছলে বুঝিয়ে দেন যে আমাদের কোনও অসুবিধেই হয় না।”
নিজেও অনেক কষ্ট করে, লড়াই করে পড়াশোনা করেছেন প্রতিমাদেবী। তাঁর বাবা কানাইবাবু আখের গুড় তৈরির কারখানায় কাজ করতেন, আর মা পাঁপড় তৈরি করে সংসার চালাতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে প্রথম তিন জনকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি কানাইবাবু। স্কুলের ঘরে বসে পুরনো কথা মনে করতে করতে প্রতিমাদেবী বলেন, “চেয়েচিন্তে বইপত্র জোগাড় করে পড়া করেছি। দু’টি শাড়ি বারবার পাল্টে পাল্টে পরে কলেজে গিয়েছি। তখন কাটোয়া যাওয়াও এত সহজ ছিল না। বাবার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করে বড় হই। খুব কষ্ট করে যা কিছু শিখেছি সবটাই আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি।” শুধু স্কুলেই নয়, স্কুলের পরেও ছেলেমেয়েদের জন্য অবারিত দ্বার তাঁর বাড়ি।
ওই স্কুলে ছাত্রী রয়েছে ৭৫০ জন। খাতায় কলমে ১৮ জন শিক্ষক শিক্ষিকা থাকার কথা হলেও রয়েছেন প্রধান শিক্ষিকা-সহ সাত জন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, অন্যান্য বিষয়গুলি সামলানো গেলেও বিজ্ঞানের ক্লাস নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। প্রধান শিক্ষিকা লতিকা মণ্ডল বলেন, “প্রতিমাদি ছাত্রীদের ডাকে সাড়া না দিলে নবম ও দশম শ্রেণিতে অঙ্ক ও ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাসই হত না।” ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক সুকান্ত রায়চৌধুরী বলেন, “দিদিমনি এই স্কুলের জন্য যা যা করেছেন, তাতে আমরা তাঁর ঋণ কোনওদিনই শোধ করতে পারব না। স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষিকার সমস্যা মেটাতে এখনও বছর খানেক লাগবে। ততদিন দিদিমনিকে আমরা ছাড়ছি না।” কিন্তু নতুন দিদিমনি এলেই কী প্রতিমাদেবীকে অবসর দেবে ছাত্রীরা?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.