পরনে লুঙ্গি জড়িয়ে অফিসারের চেয়ারে বসে তপনকুমার হালদার। ইনিই জঙ্গিপুরের মহকুমা কৃষি বিপণন আধিকারিক। বাজারের আলু, পেঁয়াজ থেকে চাল, তেলের দর দামে নজরদারি করা ও রিপোর্ট পাঠানো। অফিসেই রাত্রিবাসের পর স্নান সেরে নিজেই অফিসের গেটের তালাটা খুলে বসেছেন ঠিক ১০টা ০৫ মিনিটেই। দু’ দু’জন পিয়ন থাকা সত্ত্বেও নিজেই তালা খোলা কেন? প্রশ্ন করতেই পালটা প্রশ্ন, “কে আপনি? কেন এসেছেন? অফিসে কত জন কর্মী কেন বলব আপনাকে? কে কে আসেনি, কেন আসেনি তাই-বা কেন বলব আপনাকে?” ঝড়ের বেগে হাজারও প্রশ্নের মুখেই আমাদের চিত্র সাংবাদিককে ফাঁকা অফিসের ছবি তুলতে দেখেই এবার রে রে করে ঘরের চেয়ার ছেড়ে বারান্দায় ছুটে এলেন তপনবাবু। “কেন ছবি তুললেন? কার অনুমতি নিয়ে ছবি তুলেছেন? সরকারি নিয়ম জানা নেই?” ইত্যাদি প্রশ্নের মধ্যেই অফিসে ঢুকে পড়েছেন পাড়ারই এক যুবক। মুখ খুললেন তিনিই। “এই অফিস তো কখনও খোলা দেখি না। পাড়ায় থাকি, কই আপনাকে তো দেখিনি কোনওদিন!”ওই যুবকের পাল্টা জবাবেই এ বার তার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ওই যুবকেরই আরও তোপ, “সরকারি অফিস খুলে বসেছেন আপনি, কিন্তু লুঙ্গি পড়ে কেন? এটা কি ধরনের অফিসের পোশাক? বেলা সাড়ে দশটাতেও তিন জন কর্মীর একজনও কেন অফিসে নেই? সাধারণ মানুষের কাছে জবাব তো আপনাকেই দিতে হবে।” এ বার তপনবাবুর ভিড়মি খাওয়ার অবস্থা। তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকে প্যান্ট, শার্ট পড়ছেন। |
১০টা ২০। অফিসে ঢুকলেন জঙ্গিপুর রেগুলেটেড মার্কেট কমিটির অ্যাকাউন্ট্যান্ট। টেবিলে বাজতে থাকা তপনবাবুর মোবাইলটা ধরলেন তিনিই। বললেন, “সাহেব ব্যস্ত। জুতো পড়ছেন। পরে ফোন করুন।” তাঁর সাহেব যতক্ষণে সুটেড-বুটেড হয়ে চেয়ারে বসলেন ঘড়িতে তখন ১০টা ৩২ মিনিট। তখনও অফিসে দেখা নেই অন্য কর্মীদের কারওর-ই। তপনবাবু তখনও বলে চলেছেন, “আমি কাজে ফাঁকি বরদাস্ত করতে পারি না একদম। তিনটি পদে কাজ সামলাতে হচ্ছে আমাকে। জঙ্গিপুর রেগুলেটেড মার্কেট কমিটির সম্পাদক, মহকুমার গ্রেড অফিসার এবং কৃষি বিপণন দফতর। চার মাস এসেছি। কিন্তু এরই মধ্যে আরএমসি-র ৬ জনকে এবং আমার অফিসের দু’ জনকে ‘আন অথোরাইসড অ্যাবসেন্ট’ করে দিয়েছি।” এ বার নিজের মোবাইলে কাউকে ধরলেন। অপরপ্রান্তের লোকটিকে বলছেন, “কি, তোমরা বাজারের রিপোর্ট নিয়ে তাড়াতাড়ি আসছ তো অফিসে?” বুঝতে অসুবিধা হল না, কর্মীদেরই কাউকে ফোন করে ডাকছেন তিনি। ঘড়ি তখন ১০টা ৩৭ মিনিটের কাঁটা ছুঁয়েছে। অফিসে ঢুকলেন পিয়ন আব্দুল মাউন। দেরি হওয়ার জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার কথা তারই। কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই অফিসারের সাফাই, “বলেছি না, তোমার শরীর খারাপ। তোমাকে বাইরের কোনও কাজ করতে হবে না। কাল থেকে অফিসেই থাকবে তুমি।” |
১১টা ১৫ |
১টা ৪৫ |
ভোল পাল্টে নিজের সিটে। |
দুপুরেই পড়ে গেল তালা। |
|
১০টা ৫০। এ বারে দেখা মিলল করণিক কীর্তিচরণ ঘোষের। তিনি অবশ্য গোবেচারা মানুষ, তাই চুপচাপই রইলেন। আর এক জন কর্মী যে এ দিন আসবেন না, এ বার তা জানালেন অফিসার নিজেই। তাঁর সাফাই, “সুমতিরানি সরকারের শরীরটা ভাল নেই বলছিলেন। তাই আজ আসতে পারবেন না।” তপনবাবু আরও বলতে থাকেন, “বাজারের দর দাম নিয়ে সঠিক খবর পাঠানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর আমি মিথ্যে রিপোর্ট কখনও পাঠাই না। যেমন বাজারে এখন আলুর দাম ১৬-১৭ টাকা কেজি। পাইকারি আলু ১৪২০ টাকা কুইন্টাল।” কিন্তু সরকার যে বলছে, ১৩ টাকায় আলু বেচতে? “তা কী করে হবে। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি? এটা আবার হয় নাকি?”
এ তো গেল অফিস খোলার রকম সকম। বেলা ১টার পর ফের একই অফিসে আমরা হাজির। এ বারে দেখি মূল কোলাপসিবল গেটেই তালা ঝুলছে! হতে পারে অফিসার গিয়েছেন অন্য কাজে, কর্মীরা গিয়েছেন টিফিন করতে। ভেবে ফের হাজির বেলা ২টো ৪০ মিনিটে। একই ভাবে ঝুলছে তালা। বেলা ৩টে ১৫ মিনিট। না, সে বন্ধ তালা খোলেনি বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত!
এ দিন তার মহকুমা দফতরের এই বেহাল দশার কথা জানাতে সরাসরি ফোনে ধরা হয় বহরমপুরে বিভাগের সহকারি অধিকর্তা দেবাশিস রায়কে। বেলা ২টো ১০। মিটিংয়ে ব্যস্ত জানালেন দেবাশিসবাবু। কিন্তু মিটিং সেরেই ফোন করতে ভোলেননি তিনি। বিকেল ৪টে ৫৫ মিনিটে ফোনে সব শুনে হতবাক তিনিও। বললেন, “অফিসার অন্য দায়িত্বে কাজে যেতেই পারেন। কিন্তু যে ক’জন কর্মী আছেন, তাদের তো অফিসটা ৫টা পর্যন্ত খুলে রাখতে হবে! এই অভিজ্ঞতা সত্যিই দুঃখের। খোঁজ নিয়ে দেখছি, কেন এই হাল।” |