ইউপিএ-র বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ খুব জোরদার হয়েছে এই সরকার আর্থিক বৃদ্ধির দিকে মন দেয়নি। পুনর্বণ্টনের ওপরই সমস্ত জোর দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটা কত দূর ঠিক?
ইউপিএ ক্ষমতায় আছে প্রায় দশ বছর। গোড়ার দিকের তিন বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার যথেষ্ট চড়া ছিল। ২০০৫ থেকে ২০০৮ অবধি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বছরে গড়ে সাড়ে নয় শতাংশের কাছাকাছি হারে বেড়েছিল। চিন এবং আর তিন-চারটে দেশ ছাড়া আর কোনও বড় দেশে, সেই সময়েও, এতটা আয়বৃদ্ধি হয়নি। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। এটা একটা অসাধারণ কৃতিত্ব। প্রশংসা না করার কোনও উপায় নেই। এটা অবশ্য শুধু ইউপিএ-র কৃতিত্ব নয়। আগের পনেরো বছর ধরে ঠিক ঠিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু, ইউপিএ-র আমলে আর্থিক বৃদ্ধি হয়নি, অথবা ইউপিএ এ দিকে মন দেয়নি, এই অভিযোগ ঠিক নয়। মুশকিল হল ২০০৯ সালের মন্দার সময়। তখন গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিই একটা বড় ধাক্কা খেল। ভারতও। তবে তখন ভাবা হয়েছিল, এই ধাক্কা সামলে ফের চড়া বৃদ্ধির পথে ফিরে আসা সম্ভব হবে। নানান কারণে সেটা পুরোপুরি হয়নি।
কিন্তু, এর পাশাপাশি একটা অন্য কথা মনে রাখতে হবে। আমরা বিশ্ব ব্যাঙ্কে গোটা দুনিয়ার দারিদ্রের ছবি বিশ্লেষণ করার সময় দেখেছি, গত সাত আট বছরে ভারতে দারিদ্র বেশ রকম দ্রুত হারে কমেছে। এবং, সেটা ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলেছে।
অর্থাৎ, ইউপিএ পুনর্বণ্টনের যে নীতি নিয়েছিল, সেটা কার্যকর হয়েছে। উন্নয়নের অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বলা হয়, এই সরকারের মূল কৃতিত্ব অধিকারভিত্তিক কল্যাণনীতি নিয়ে আসা। আপনি কি ইউপিএ-র কল্যাণ কর্মসূচিকে একটা নতুন যুগের সূচনা বলবেন?
যুগান্তর বা প্যারাডাইম শিফ্ট বেশ বড় কথা। সেটা বলব না। তবে, কর্মসূচির নিরিখে উল্লেখযোগ্য তো বটেই। আমি মনে করি, অধিকারভিত্তিক কল্যাণনীতির ক্ষেত্রে একটু সাবধান হওয়া ভাল। খাতায়-কলমে অধিকার দিয়ে দিলাম, কিন্তু বাস্তবে সেই অধিকার রক্ষা করতে পারলাম না, এটা কোনও কাজের কথা হতে পারে না। ইউপিএ যে অধিকারগুলো দিয়েছে, তার বেশির ভাগই জরুরি। খাদ্যের অধিকার থাকাই উচিত। আমি মনে করি, সেই অধিকার রক্ষা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য ভারতের আছে। শিক্ষার অধিকারও জরুরি। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যের অধিকারের ব্যবস্থাও করা যেত। কিন্তু কর্মসংস্থানের অধিকার দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। এটা একটু গোলমেলে। কারণ, একশো শতাংশ কর্মসংস্থানের যে সায়েন্স, সেটা এখনও আবিষ্কার হয়নি। ফলে, এই অধিকারটা অন্য অধিকারগুলোর চেয়ে আলাদা।
ইউপিএ গত দশ বছরে ভারতে যে ভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, সেটা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে কী রকম দেখাচ্ছে?
কিছু দেশে ভারতের মতো নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রাজিলে যেমন লুলা ডি সিলভা কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার করেছিলেন। বেশ বড় মাপে। তার ফলে ব্রাজিলে আর্থিক অসাম্য অনেকটাই কমেছে। দারিদ্রও কমেছে। কিন্তু আবার এখন সে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ভারতের চেয়েও কম। আমার ধারণা, ভারতে আর্থিক অসাম্য অসহ্য রকম বেশি। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা, কমিয়ে আনা খুবই প্রয়োজন।
গত বছর ভারতীয় অর্থনীতিতে মূল তর্কটা ছিল বৃদ্ধি বনাম পুনর্বণ্টনের। সেই আলোচনা থেকে মনে হয়, এই দুটোর মধ্যে বুঝি অনপনেয় বিরোধ আছে। মানে, কোনও সরকার বৃদ্ধির দিকে মন দিলে তার পক্ষে পুনর্বণ্টনে জোর দেওয়া সম্ভব নয়। অন্য দিকে, কোনও সরকার যদি পুনর্বণ্টনের কথা বলে, ইউপিএ যেমন বলেছে, তার পক্ষে বৃদ্ধির চড়া হার বজায় রাখা অসম্ভব। সত্যিই কি এমন কোনও বিরোধ আছে?
আমার তা একেবারেই মনে হয় না। দুটো একই সঙ্গে চলতে পারে। চলা উচিতও। এই প্রসঙ্গে আবারও বলি, ইউপিএ-র আমলে বৃদ্ধির হার আগাগোড়া খারাপ ছিল, তা নয়। প্রথম কয়েক বছরে সাড়ে নয় শতাংশ বৃদ্ধির হারের কথা তো একটু আগেই বললাম। তার পরেও, এখনও, ভারত যে পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি হারে আয় বাড়াচ্ছে, সেটা নেহাত কম নয়। অমর্ত্যদাও এই কথাটা জোর দিয়ে বলেছেন। আর্থিক বৃদ্ধির হারে ভারত এখনও দুনিয়ার প্রথম দশটা দেশের মধ্যে একটা। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখবে, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে আয় কমে গিয়েছে। পর্তুগাল, ইতালি, গ্রিস, স্পেন সব দেশেই অর্থনীতি বাড়ার বদলে সঙ্কুচিত হচ্ছে। যদি মাথাপিছু আয়ের কথা ধরো, তা হলে ফ্রান্স আর সুইডেনেও আয় হ্রাস পেয়েছে। সেখানে ভারতের পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির হারকে কোন যুক্তিতে খারাপ বলব? আসলে মানুষ এক বার নয় শতাংশ বৃদ্ধির হারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার পর এই পাঁচ শতাংশ হারকে বড্ড কম মনে হতে থাকে। তবে, ইউপিএ-রও ভুলভ্রান্তি আছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জন্য যদি কিছুটা ক্ষতি হয়ে থাকে, বাকিটা নিজেদের দোষে হয়েছে। একটা সময় থেকে এই সরকার নীতিগত সংস্কারের ক্ষেত্রে কেমন যেন মুখ থুবড়ে পড়ল। জমি অধিগ্রহণই হোক বা শিল্পের জন্য পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র, সব প্রশ্নেই নীতিপঙ্গুত্বের কারণে বড্ড বেশি সময় লাগে এখানে। বৃদ্ধির হারের ওপর তার একটা প্রভাব পড়বেই।
|
সম্প্রতি যে বিধানসভা নির্বাচনগুলো হয়ে গেল, তাতে কংগ্রেসের ভরাডুবিকে অনেকেই ইউপিএ-র নীতির বিরুদ্ধে মানুষের রায় হিসেবে দেখছেন। বলা হচ্ছে, বৃদ্ধিবিমুখ যে পুনর্বণ্টনের নীতি ইউপিএ নিয়েছে, মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আপনি কী ভাবে দেখছেন?
সত্যিই মানুষ ইউপিএ-র নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে কি না, আমি জানি না। ২০০৫ সাল থেকে ভারতীয় অর্থনীতি যে রকম ভাবে চলেছে, গোটা দুনিয়ার খুব কম দেশ সেটা করতে পেরেছে। এই সরকারের মূল ব্যর্থতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা। ছোট-বড় সব ক্ষেত্রে এই তুমুল দুর্নীতি মানুষকে চটিয়ে দিয়েছে। আগেই বললাম, এবং আরও এক বার জোর দিয়ে বলছি, সরকারের একটা বড় কর্তব্য আছে দেশের মানুষের মধ্যে আর্থিক অসাম্য কমানো। লাতিন আমেরিকার গোটাকতক দেশ ছাড়া গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক অসাম্য বাড়ছে। আমার মতে, মানুষে-মানুষে এই বিপুল অসাম্য থাকাটা অনুচিত এবং অনৈতিকও। এই অসাম্যের বিরুদ্ধে আমাদের সবারই প্রতিবাদ করা উচিত।
চটে যাওয়ার আর একটা কারণ হতে পারে মূল্যস্ফীতি। যে ভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে, তাতে অনেকের পকেটেই বিস্তর চাপ পড়েছে। কিন্তু মানুষের বোঝা দরকার, বাজারের মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ করতে পারার কোনও ম্যাজিক ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে, মূল্যস্ফীতি হলেই সরকারের পক্ষে দাম কমিয়ে দেওয়া অসম্ভব। এটা কী রকম জানো ধরো, অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হওয়ার আগে কি ডাক্তারদের দোষ দেওয়া যেত যে কেন তাঁরা রোগের উপশমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন না? ঠিক এই ভাবেই, মূল্যস্ফীতির জন্যও সরকারের ঘাড়ে পুরো দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। সরকার অবশ্যই কিছু কাজ করতে পারে। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ সামলে রাখতে পারলে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা কমে।
কিন্তু, বাজারে আগুন লাগলে মানুষ তো চটবেই। সেই রাগ সরকারের ওপরেই পড়বে। তা সামলাতে কী করণীয়?
অন্য দিকগুলোয় মন দেওয়া দরকার। আর্থিক বৃদ্ধি চাই, আবার দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রেও সত্যিই সচেষ্ট হতে হবে। আমার তো মনে হয় শুধু দুর্নীতি ঠেকাতে না পারাতেই এই অবস্থা হল। এটাই ইউপিএ-র সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
|
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত। |