বুধবারের কলিকাতার স্তব্ধ রাজপথ জানাইয়া দিল, বামপন্থীরা বদলান নাই। তাঁহাদের অবস্থা বিক্রমাদিত্যের প্রায়। রাস্তার রাজনীতি নামক বেতালকে ঘাড় হইতে নামাইবার সুযোগ তাঁহাদের নাই। ফলে, ১৯৬০-এর দশকের নেতির রাজনীতির উত্তরাধিকার তাঁহারা ২০১৪ সালের কলিকাতায় বহন করিয়া চলিতেছেন। সেই গ্রামগঞ্জ হইতে বাস বোঝাই সমর্থক লইয়া আসা, সেই জনজীবন অচল করিয়া দেওয়া, সেই নেতির রাজনীতির ট্র্যাডিশন চলিতেছে। তবে কিছু বৈচিত্রও আসিয়াছে। যে ভঙ্গিতে সভামঞ্চে একের পর এক ‘শহিদ’-এর পরিজনের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলিয়া দেওয়া হইল, তাহা বিলক্ষণ নূতন। বামপন্থীরা কালীঘাটের পাঠশালায় নাম লিখাইয়াছেন বলিয়া অনুমান। বিমান বসুরা মাঝেমধ্যেই বলিয়া থাকেন, তাঁহারা আড়াই বৎসর চুপ করিয়া ছিলেন, এখন ফের সক্রিয় হইতেছেন। সক্রিয়তার নমুনা যদি ইহা হয়, তবে বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা দুষ্কর।
অথচ, বঙ্গজ বামপন্থীদের এখন আর সাইনবোর্ড ভিন্ন কিছু হারাইবার নাই। নূতন করিয়া শুরু করিবার এমন সুযোগ বারবার আসে না। তাঁহাদের দলের মেদ ঝরিয়া গিয়াছে। স্বার্থের সন্ধানে আর কেহ তাঁহাদের খাতায় নাম লেখান না। এখনই নেতৃত্বে আমূল বদল ঘটাইবার, নূতন প্রজন্মকে তুলিয়া আনিবার সুযোগ ছিল। কিন্তু বুধবারের কলিকাতা দেখিল, বিমান বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-গৌতম দেবরাই আসর আলো করিয়া আছেন। এখনই সুযোগ ছিল রাস্তার রাজনীতি ভুলিয়া, ক্ষমতার অভিমান বিস্মৃত হইয়া মানুষের কাছে যাওয়ার। এখনই রাজনীতির নূতন ইতিবাচক ভাষ্য রচনার অবকাশ হইয়াছিল। সেই সুযোগও তাঁহারা জলাঞ্জলি দিলেন। ষাটের দশক আসিয়া একুশ শতকের সম্ভাবনাকে লইয়া গেল। ভারতে রাজনীতির যে একটি নূতন দিক খুলিয়া যাইতেছে, বামপন্থীরা তাহাও দেখিতে পাইলেন না। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রাজনীতির ভঙ্গি নিঃসন্দেহে বামপন্থীদের ন্যায়, রাস্তার কিন্তু সেই রাজনীতির ভিতরের ভাষাটি ভিন্ন। তাহা সাধারণ মানুষের অভিযোগের ভাষা। কেজরিওয়ালের রাজনীতির ভ্রান্তি অন্যত্র আলোচ্য, কিন্তু মানুষের ভাষায় কথা বলিবার নূতন রাজনীতিটিও বামপন্থীরা শিখিতে পারিলেন না। তাঁহারা যেমন ছিলেন, তেমনই থাকিলেন। ফলে আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতেও থাকিবেন।
ষাটের দশকের উত্তরাধিকার অপেক্ষা গুরুতর বোঝা অবশ্য বামপন্থীদের বহিতে হয়। উনিশ শতকের কিছু তত্ত্বের বোঝা। তাঁহাদের ভাবভঙ্গিতে বোঝ হয়, সেই বোঝাই তাঁহাদের চক্ষের মণি, বুকের পাঁজর। অতএব, দেশ জুড়িয়া যখন নীতি নির্ধারণের তর্ক চলে, বামপন্থীরা তখন তত্ত্বের বোঝায় উত্তর হাতড়ান, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি দুই চারটি শব্দ ছুঁড়িয়া মারেন এবং চুপ করিয়া যান। পশ্চিমবঙ্গ গত আড়াই বৎসর যে পথে চলিতেছে, তাহার কোনও গঠনমূলক সমালোচনা, কোনও বিকল্প পথের হদিশ বামপন্থীদের নিকট পাওয়া যায় নাই। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনও বস্তুমুখী বিশ্লেষণও তাঁহারা করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ফলে, রাজ্যের এবং দেশের রাজনীতিতে তাঁহারা সমপরিমাণ অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িয়াছেন। উদ্ধারে পথ একটিই। নিজের নূতন ভাবে খুঁজিয়া মানুষের দরবারে পেশ করিতে হইবে। তাহারও পূর্বে, পিঠের বোঝাটি নামাইয়া রাখিতে হইবে। দীর্ঘ পথ যাইতে হইলে হালকা থাকাই বাঞ্ছনীয়। |